১ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৫:৩৫

কূটনৈতিক ব্যর্থতায় বৈদেশিক সহায়তা ছাড়ে পিছিয়ে পড়েছে সরকার

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে। এবছর বিশাল অংকের এডিপির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বাস্তবায়নের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ করা হলেও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে এডিপি বাস্তবায়নের হার। এদিকে বৈদেশিক অর্থ সহায়তা ছাড়ে পিছিয়ে পড়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরকার দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ থেকে ছাড় করাতে পেরেছে মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ কোটি ডলার কম। একদিকে ঋণ হিসেবেও ছাড়ের পরিমাণ কমেছে অন্যদিকে অনুদান হিসেবে ছাড় করানো পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থ ছাড়ের সঙ্গে এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতিও কমেছে। এটাকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জন্য প্রায় এক লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকার এডিপি গ্রহণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরের এডিপি’র আকার ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ এবার গতবারের চেয়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। কিন্তু প্রথম চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে আগের বছরের চেয়েও বাস্তবায়নের হার কমেছে। চলতি সময়ে এডিপির ১৪ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল ১৫ শতাংশ।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের (জুলাই-অক্টোবর) প্রথম চার মাসে ২৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চার মাসের এ বাস্তবায়ন মোট বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
এদিকে আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া দশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ১৭৬ কোটি টাকার কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অংক মোট বরাদ্দের ২৮ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ২১ শতাংশ বা ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা বা বরাদ্দের মাত্র ৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ।
এরপর বেশি পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গুলোর মধ্যে যথাক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পেরেছে ১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ। রেলপথ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৩৮১ কোটি টাকা বা বরাদ্দের মাত্র ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সেতু বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৬২২ কোটি টাকা বা বরাদ্দের প্রায় ৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে ৯৯১ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ১১ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেছে ৪৪২ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে ৪৬১ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেছে প্রায় ২৮১ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৫ শতংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনী ব্যস্ততায় এডিপি বাস্তবায়ন কমেছে। তারা বলেন, মূলত উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে জড়িত ঠিকাদাকার ও কর্মকর্তাদের অনেকেই এখন জাতীয় নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এরফলে প্রকল্পগুলোর কাজ কিছুটা থেমে আছে। এরফলে বাস্তবায়ন শ্লথ হয়ে পড়েছে। চার মাসের বাস্তবায়নে আসলে আনুপাতিক হারে বাস্তবায়ন কিছুটা কমেছে।
এদিকে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রথম চার মাসে বৈদেশিক সহায়তা ছাড়ে পিছিয়ে পড়েছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ থেকে ছাড় হয়েছে ১৩৩ কোটি ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ কোটি ডলার কম। চলতি অর্থবছরে সরকার সব দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ৭১৭ কোটি ডলার ছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। গত অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১৩ কোটি ডলার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় হয়েছে ১৩৩ কোটি ডলার। এরমধ্যে ঋণ হিসেবে ১২৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আর অনুদান হিসেবে ছাড় হয়েছে ৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এর আগে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ১৪৬ কোটি ডলার ছাড় হয়েছিল। এরমধ্যে ঋণ হিসেবে ১৩৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলার আর অনুদান হিসেবে ১০ কোটি ৫৯ লাখ ডলার ছাড় হয়।

অর্থ ছাড়ের সঙ্গে এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতিও কমেছে। এ চার মাসে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৩৬১ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এরমধ্যে ঋণের হিসেবে ৩১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার, অনুদান হিসেবে ৫০ কোটি ৬১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে দাতাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় হয়েছিল ৫৬৫ কোটি ডলার। এরমধ্যে ৫৫৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ঋণ এবং ৯ কোটি ২৪ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে প্রতিশ্রুতি ছিল।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দাতাদের কাছে পুঞ্জিভূত পাওনা থেকে ৫২ কোটি ৪২ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে সুদ হিসেবে ১৩ কোটি ডলার এবং আসল পরিশোধ করেছে ৩৯ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট ৪৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল। এতে আসলের পরিমাণ ছিল ৩৬ লাখ ডলার। এছাড়া সুদ হিসাবে পরিশোধ হয়েছে ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
গতবারের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা বাড়লেও কমেছে অর্থ ছাড়ের পরিমান। ছাড় করাতে না পারা সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ছাড় যেমন কমেছে তেমনি অনুদানের ছাড়ের পরিমান অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার অর্থ ছাড়ের সঙ্গে এই অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতিও কমেছে। এতে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে।

http://www.dailysangram.com/post/355456