২৯ এপ্রিল ২০২৪, সোমবার, ৭:৩৮

হিটস্ট্রোকে সারাদেশে ৬ জনের মৃত্যু চরম ভোগান্তিতে নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রবল দাবদাহে পুড়ছে প্রায় গোটা দেশ। তাপপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে আবহাওয়া অধিদফতরের জারি করা ‘হিট অ্যালার্ট’ বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তার সময় আরও তিন দিন বাড়ল। রোববার সকালে অধিদফতর আগামী ৭২ ঘণ্টার জন্য নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছে। এর আগে গত ২৫ এপ্রিল তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করে আবহাওয়া বিভাগ। সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে শনিবার। রোববার তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ রোববার থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সারা দেশ থেকে আকস্মিক মৃত্যুর খবর আসছে। রোববার সারা দেশে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

গত কিছুদিন ধরে দেশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গত ৩১ মার্চ থেকে টানা বইছে এ তাপপ্রবাহ। আগামী মাসের (মে) প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টি বেড়ে তাপপ্রবাহের আওতা কমতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। প্রবল গরমে কষ্ট পাচ্ছে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ। অধিকাংশ অঞ্চলে তাপদাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
তীব্র তাপপ্রবাহে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সারা দেশ থেকে আকস্মিক মৃত্যুর খবর আসছে। রোববার সারা দেশে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে হিট স্ট্রোকে মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকালে চট্টগ্রাম নগরের বাসা থেকে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

রাজশাহীতে হিটস্ট্রোকে দিলীপ বিশ্বাস (৩৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মারা যান তিনি। তিনি রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার দামকুড়া থানার কাদিপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছেন, দিলীপ বিশ্বাস সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন। রোববার সকালে হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। তারা ধারণা করছেন, বৈশাখের এই তীব্র গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।

যশোরে অব্যাহত তাপ প্রবাহে হিটস্ট্রোকে আহসান হাবীব (৩৭) নামে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি যশোর আমদাবাদ হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। এ নিয়ে যশোরে হিট স্ট্রোকে তিন জনের মৃত্যু হলো। এর আগে, যশোর সদর ও মনিরামপুরে একজন করে হিট স্ট্রোকে মারা যান। আমদাবাদ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ জেড এম পারভেজ মাসুদ বলেন, শিক্ষক আহসান হাবীব সকালে মাঠে কাজ করে ৯টার দিকে স্কুলে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে আদালত প্রাঙ্গণে সুলতান উদ্দিন মিয়া (৭২) নামে এক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। রোববার দুপুর ৩টার দিকে তার মুত্যু হয়। তিনি নরসিংদী কোর্টে আইনজীবীর সহকারী (মুহুরি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, মৃত সুলতান উদ্দিন মিয়া সকালে প্রতিদিনের মতো বাসা থেকে বের হয়ে নরসিংদী কোর্টে যান। কোর্টে কাজ করার সময় দুপুরে তার বুকে ব্যথা অনুভব হয়। পরে সে আদালতের মসজিদের সামনে এলে পড়ে যান। লোকজন উদ্ধার করে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাদারীপুরে তীব্র তাপপ্রবাহে অসুস্থ হয়ে দুই জন মারা গেছেন। নিহতদের একজন খুচরা ব্যবসায়ী ও অপরজন কৃষক।

রোববার বেলা আড়াইটার দিকে জেলার কালকিনি উপজেলার পশ্চিম শিকারমঙ্গল এলাকায় ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী শাহাদাত সর্দার (৫৫) ও ২টার দিকে ডাসার উপজেলার কাজীবাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামের মোসলেম ঘরামি (৬০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলাউল হাসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, প্রচ- গরমে দুই জন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ৭২ ঘণ্টার জন্য জারি করা এই সতর্কবার্তা থাকাকালীন সময়ে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। কিছু কিছু জেলায় তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে, মে মাসের শুরু নাগাদ রাজধানীসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রথমবার তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়। এরপর থেকে কয়েক ধাপে তা বাড়ায় আবহাওয়া অফিস।

এদিকে তাপদাহের মধ্যে উচ্চবিত্তদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাটলেও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষ। তীব্র গরমে ঠিক মতো কাজ না করতে পারায় আয় কমেছে শ্রমজীবীদের। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কর্মজীবীদের জীবন যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘাম ঝরিয়ে ছুটতে হচ্ছে তাদের। কেউবা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন ছায়ার নিচে। গরমের কারণে দীর্ঘ সময় কাজ করতে না পারায় কমে গেছে তাদের আয়ের পরিমাণও। গরমে কষ্ট কয়েক গুণ বাড়লেও কমেছে আয়।
সারাদিন রিকশা চালিয়ে ৬০০-৭০০ টাকা আয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে রিকশা চালকদের। গরমে পুরো দিন রিকশার প্যাডেল টানতে পারেন না। অর্ধবেলা গাড়ি টেনে আয় করেন ৩০০/৪০০ টাকা। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার রিকশাচালক মাইদুল বলেন, ‘যে গরম, গরমে রিকশা চালাইতে খুব কষ্ট হয়। একটানা চালাইতে পারি না, শরীর দুর্বল হইয়া যায়। বিশ্রাম নেওন লাগে। গরমে বেশি চালাইতে পারি না বইলা কামাই রোজগারটাও কমে গেছে। আগে হয়তো সকাল থেকে আগে সকাল থেইকা দুপুর পর্যন্ত ৪০০-৫০০ টেকা কামাই হইত। অহন ৩০০ কামাইতে জান বাইর হইয়া যায়।’

একই এলাকার আরেক রিকশা চালক বলেন, ‘গরমে মানুষ ঘর থেইকা বাইর হয় না। আমরাও ঠিকমত রিকশা টানতে পারি না। এতে ঠিকমত আয় হয় না।’ রিকশাচালক জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গরমে গাড়ি টানা যায় না মামা। বার বার পানি খাই। পানি শরীরে থাকে না। বের হয়ে যায়। কী করমু। তারপরও গাড়ি চালাই। পেটে ভাত দিতে অইবো তো।

শাহবাগ এলাকার আরেক রিকশাচালক বলেন, ‘এই গরমে রিকশা নিয়া রাস্তায় বের হওয়াই ভয়ের। বেশি দূরের ভাড়ায় যাই না। আধা ঘণ্টা রিকশা চালাই, আর আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নেই। আবার অতিরিক্ত গরমের কারণে লোকজনও কম বের হচ্ছে। ফলে ভাড়াও বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে তীব্র তাপদায়ে যাত্রী কমেছে গণপরিবহনেও। রাজধানীতে বিমানবন্দর-যাত্রাবাড়ী রুটের বাসচালক আনিসুল জানালেন, বেশির ভাগ বাসেই যাত্রী সংখ্যা হাতেগোনা। সকালের দিকে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দিনের বেলা যাত্রীদের দেখা মিলছে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া এই গরমে মানুষ বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না, যার প্রভাব পড়ছে গণপরিবহনেও।
এছাড়াও তীব্র গরমে তেমন বেচাবিক্রি নেই ফুটপাতের দোকানগুলোতে। রাজধানীর গুলিস্তানে পোশাক ফুটপাতে পোশাক বিক্রেতা হারুন বলেন, অন্যান্য সময়ের মতো বিক্রি হয় না। কাস্টমার নাই বললেই চলে। শেষ বিকালে কাস্টমার কিছুটা বাড়ে। তখন রোদ একটু কম থাকে। আবার অনেক অফিসে ছুটি হয় বিকালে, তখন বেচাকেনা কিছুটা বাড়ে। রোদ বেশি থাকায় ফুটপাতে চৌকির উপর ছাতা লাগিয়েছেন দোকানিরা। এক দোকানদার বলেন, ‘আমার আগে ছাতা ছিল না। এখন রোদের কারণে ছাতা লাগিয়েছি। এতে আমি একটু ছায়া পাই, কাস্টমারও যেন এসে দাঁড়াতে পারেন। এখন ছাতার নিচে বসে আছি, কোনো কাস্টমার নেই।

সুস্থ থাকার উপায়
গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে বেশি করে পানি পান করতে হবে। সেইসঙ্গে পান করতে হবে বেশি করে ফলের রস এবং ওরস্যালাইন। তবে দিনে দুটির বেশি স্যালাইন পান করবেন না। ওরস্যালাইন তৈরির আগে প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা মেনে তবেই তৈরি করুন। শসা, তরমুজ ও ডালিম খাবেন নিয়মিত। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় গরমে থাকা এড়িয়ে চলুন। চেষ্টা করুন তুলনামূলক শীতল তাপমাত্রায় থাকার। পোশাক হিসেবে সুতির ঢিলেঢালা জামা ব্যবহার করুন।

https://www.dailysangram.info/post/554807