১ ডিসেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৫:৩৬

বিতর্কের কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশন

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সমালোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে এখনো রয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সব পক্ষের জন্য সমান সুবিধার পরিবেশ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। অথচ এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কিছু করতে দেখা যায়নি। গতকাল প্রকাশ হওয়া যুক্তরাজ্যের এক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে দাবি ছিল তা হলো জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের যে বিন্যাস তৈরি করে সরকার নির্বাচন করার ছক করেছে তাতে পরিবর্তন আনা। আর গতকাল নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানিয়ে দিয়েছেন বিদ্যমান প্রশাসনে কোনো ধরনের পরিবর্তনই আনবে না কমিশন। এর আগে ইভিএম নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হওয়া এবং এটাকে ভোট কারসাজির হাতিয়ার বানানোর জন্য ব্যবহার করা হবে মর্মে তীব্র সমালোচনার পরও ইসি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দান নিয়েও একতরফা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস এবং রংপুরে ২০ দল মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক গোলাম রাব্বানির মনোনয়ন কোনো কারণ ছাড়াই গ্রহণ করেনি রিটার্নিং অফিসার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন প্রতিকারমূলক কোনো হস্তক্ষেপ করেছে বলেও জানা যায়নি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা অবশ্য নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছে বলে দাবি করে সম্প্রতি এক সভায় বলেন, আমরা আশা করেছিলাম একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে, আমাদের সে আশা পূরণ হয়েছে। আশা করেছিলাম প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে, সে প্রত্যাশাও পূর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে। সেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশও সৃষ্টি হয়েছে। সিইসি বলেন, দেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, দেশে যারা রাজনীতি করেন, যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, তারা নির্বাচনী আইন, বিধিমালা মেনে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

সংসদ নির্বাচন নিয়ে উৎসবের আমেজ থাকার কথা থাকলেও সেখানে ওই উৎসবের মধ্যে এখন এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচনী পরিবেশে চলছে গ্রেফতার ও মামলার আতঙ্ক। ফলে নির্বাচনী মাঠে একতরফাভাবে রয়েছে সরকারদলীয় জোটভুক্ত দলগুলো। তফসিল ঘোষণার পর সব দলের জন্য নির্বাচনী কার্যক্রমে সমান সুযোগ দেয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত তা নিশ্চিত করতে পারেনি। উল্টো বিরোধী দল ও জোটের নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের গ্রেফতারের ধারা অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। এই আতঙ্কজনক পরিবেশ, অব্যাহত গ্রেফতার এবং সবাইকে সমান সুযোগ না দেয়া ইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে সুশীলসমাজ মনে করছে। তাদের মতে, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো পরিবেশ তারা এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মতো কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। তাদের কার্যক্রম থেকে মনে হয়, তারা অদক্ষ একটা কমিশন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়েও একটা শঙ্কা কাজ করছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ইতোমধ্যে ২৩ দিন অতিক্রম হয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচন শুধু সরকার আর বিরোধী দলের জন্য নয়, নির্বাচন কমিশনের জন্যও মহাপরীা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের মতে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম দেখে বলা যাবে না আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হবে। আজ পর্যন্ত তাদের কাজে সে ধরনের কোনো আলামত আমরা পাইনি। তারা ঠিকমতো এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের আচরণে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। সব রাজনৈতিক দলের জন্য তারা এখনো পর্যন্ত কোনো সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি। ফলে নির্বাচনটা কেমন হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে।

তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে প্রার্থীরা বিশেষ করে বিএনপির প্রার্থীরা আতঙ্কে ছিলেন। গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে নিজে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যেতে পারেননি। অন্যকে দিয়ে পাঠাতে হয়েছে। আবার রিটার্নিং অফিসারও অনেক বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা নেননি। এটা ইসির কী ধরনের আচরণ। যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তারাও নিজ দলীয় কর্মীদের সাথে দেখা করতে পারছেন না। এই আতঙ্কটা দূর করা ইসির দায়িত্ব ছিল। এখন গ্রেফতার বন্ধ করাও ইসির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ফলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো পরিবেশ ইসি সৃষ্টি করতে পারেনি।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দিলারা চৌধুরীর মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ তৈরি করা দরকার বর্তমান কমিশন তা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো পর্যন্ত তাদের অনেক সিদ্ধান্তই পক্ষপাতমূলক। আর সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মতো কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান না। তাদের কার্যক্রম থেকে এটাই মনে হয়, তারা অদক্ষ একটা কমিশন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেও সেখানে যে কূটনৈতিক কৌশল নেয়া দরকার সে বুদ্ধিও তাদের নেই। তাদের পক্ষপাতের কার্যক্রম সবই দৃশ্যমান। আগের শামসুল হুদা কমিশনেও সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু তাদের নিয়ে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। নিজেরা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে মুক্ত হতে চাইলে তাদের বলা উচিত, এমন পরিবেশে আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারব না; যা করেছিল ভারতের একটি রাজ্যসভা নির্বাচনের সময় সেখানকার নির্বাচন কমিশন।
দিলারা চৌধুরীর মতে, দলীয় সরকার এবং একটা সংসদ বহাল রেখে আরেকটা সংসদ নির্বাচনের আয়োজন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর বর্তমান অদক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা কখনোই সম্ভব হবে না তার প্রমাণ কবিতা খানমসহ কমিশনাররা তাদের বক্তব্যে দিয়েছেন। কবিতা খানম নিজেই তো বলেছেন বাংলাদেশে নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবে না। দুনিয়ার কোথাও তা হয় না।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক করা নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন। কোনো ধরনের অনানুষ্ঠানিক যোগদান হলে তা হবে দলীয় প্রধানের কাছে। আর তা হবে দলীয় কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হবে ছোট আকারের। কিন্তু কার্যত তিনি পুরো মন্ত্রিসভাই বহাল রেখেছেন।

নির্বাচনের বর্তমান পরিবেশ নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজ নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের কাজ। ইসির কাছে এখন সরকারি দল ও বিরোধী দল সবাই সমান। নির্বাচনী প্রচারণায় সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। তা না করতে পারলে ইসি নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখতে পেলাম আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে প্রার্থীরা। এখানে দলগতভাবে তারা মিছিল করছে। ইসির উচিত প্রতীক বরাদ্দের আগে এসব প্রচারণা কঠোরভাবে বন্ধ করা। এখন যদি তারা শক্ত হাতে এসব বন্ধ করতে না পারে তাহলে সামনে তাদের জন্য পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে।
এখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার আশ্বাস দেয়া হলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। গণভবনে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করা হবে না বললেও তিনি সেই অঙ্গীকার রা করেননি। তফসিলের পরও সারা দেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমনকি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রী আচরণবিধি অমান্য করলেও নির্বাচন কমিশন তাতে কর্ণপাত না করে নির্বাচন নিয়ে সরকারের গোপন মিশনগুলোর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছে। মূলত জাল-জোচ্চুরি-প্রহসনের ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তার।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এবার নির্বাচনটা অনেক দিক থেকে ভিন্ন। ২০১৪ সালের তুলনায় এবার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে প্রতিযোগিতামূলক হবে কি না তা দেখার বিষয়। কিন্তু নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার েেত্র যে রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা আগে ছিল এবার তেমন নেই। কারণ এখনো অনেকের মনোনয়ন অনিশ্চিত। তিনি বলেন, বিএনপির প থেকে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তারাই যে মনোনয়ন পাবেন এটার অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। বিরোধী দলের অনেকের নামে মামলা আছে। গায়েবি মামলা আছে এবং এখনো বিএনপির নেতাকর্মী গ্রেফতার হচ্ছে। সার্বিকভাবে আমি বলব না এটা একটি উৎসবমুখর পরিবেশ। যেটা সাধারণত আমাদের নির্বাচনে হয়। তবুও এটা ইতিবাচক দিক যে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন আমাদের আকাক্সা একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হবে। সেখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী সবার জন্য সমতল ত্রে প্রস্তুত করবে।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/368727