৩০ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ১২:৩৮

ওসিদের নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা ॥ ফটোসেশন

* নির্বাচনী প্রস্তুতি সভায় অংশ নেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম- ব্যক্তিগত গাড়িতে জাতীয় পতাকা
* প্রার্থীদের কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি- সিইসি
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের নানারকম প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু এসব প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ বেশ জোরেশোরেই উঠে আসছে।

যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত একদিকে যেমন প্রচারণা নিষিদ্ধ, অন্যদিকে এসময় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি সুবিধা ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে? আর নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সব দলের জন্য সমান সুযোগই বা কতটা তৈরি হচ্ছে? এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছেই।
এমন প্রশ্ন জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়ার মধ্যেই দেশের একাধিকস্থানে বুধবার সরকারি দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের সংশ্লিষ্টতার পর তাদের ফটোসেশনের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমের পাতায় উঠে আসার পর তা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এসবকে নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘনসহ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী না হওয়াটাকেই ‘কারণ’ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ৩০০ নির্বাচনী আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া প্রার্থীদের কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি ‘লঙ্ঘন করেননি’ মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর একটি অংশগ্রহগণমূলক নির্বাচন করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।
গাইবান্ধায় আ’লীগ প্রার্থীর সঙ্গে দুই ওসির ফটোসেশন
গাইবান্ধা-৫ আসনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় আওয়ামীলীগ প্রার্থীর সাথে দুই ওসির ফটোশেসন ইতোমধ্যে সবর্ত্রই সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। বুধবার দুপুরে গাইবান্ধা-৫ আসনের (ফুলছড়ি-সাঘাটা) এমপি ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। তিনি সাঘাটা উপজেলার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাহী অফিসার উজ্জল কুমার ঘোষের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন।

অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার সাথে ফটোশেসনে অংশ নেয়া দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন-সাঘাটা থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ও পলাশবাড়ী থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সি।
বিষয়টি নিয়ে ওসি হিপজুর আলম বলেন, আমরা সেখানে ছিলাম। আমাদেরকে ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশে তোলা হয়নি। এতে নির্বাচনী নীতিমালা লঙ্ঘিত হয় নি। তবে এটি নিয়ে কেউ বিতর্কের সৃষ্টি করলে কারো কিছুই করার নেই। এমন ছবি সারাদেশে অনেকেই তুলেছেন।
এ বিষয়ে ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহযোগিতার উদ্দেশ্য সেখানে গিয়েছি। আমরা ইউএনওর সঙ্গে ছিলাম। তাকে সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেয়া আমাদের দায়িত্ব। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা তা গ্রহণ করেছেন। আমরা সঙ্গে ছিলাম। এর বেশি কিছু নয়।

সিলেটে ওসিকে সঙ্গে নিয়ে এমপির মনোনয়নপত্র জমা
সুনামগঞ্জে থানার ওসিকে সঙ্গে নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এমপির মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ঘটনায় চলছে সিলেটজুড়ে আলোচনা সমালোচনা। বুধবার সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি জামালগঞ্জ থানার ওসি আবুল হাসেম তার সঙ্গে ছিলেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার এ ছবি দলীয় নেতা-কর্মীরা তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেন। এরপরই ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন কমিশন যেখানে বলছে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়েছে। এমপিরা নির্বাচনী প্রচারণায় কোন সরকারি সুযোগ সুবিধা নেবেন না। সেখানে একজন এমপির মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় থানার ওসিকে সঙ্গে রাখা নির্বাচণ আচরণ বিধির মধ্যে পড়ে কি? এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির প্রার্থী নজির হোসেন বলেন, ফেসবুকে বিষয়টি দেখেছি। এটি নিন্দনীয়। এতে প্রমাণিত হয়েছে, আমরা যা বলে আসছিলাম তাই ঠিক। নির্বাচনী মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। প্রশাসন প্রকাশ্যে সরকারি দলের লোকজনকে সহযোগিতা করছে। নির্বাচন কমিশন যা বলছে তা মিথ্যে প্রমাণীত হয়েছে। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার। নির্বাচন কমিশন ইচ্ছে করলেই তা সম্ভব। নজির হোসেন বলেন, নির্বাচনী ইতিহাসে একজন প্রার্থীর সঙ্গে ওসি গিয়ে মনোনয়ন জমা দেয়ার ঘটনা এই প্রথম। আমি এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা আছে?

২৬ নবেম্বর ২০১৮। স্থান-নরসিংদী পৌরভবন। ভবনের একটি অডিটোরিয়ামে চলছে নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা। সভায় নৌকা মার্কার শ্লোগান দিয়ে একের পর এক নেতা-কর্মীরা আসছেন। বিকেল নাগাদ সভায় অংশ নিতে আসেন স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হিরু। দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসেছেন তিনি। একটু অপেক্ষার পরই দেখা গেলো সদর থানার ওসি সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে আসছেন।
সভা শেষে এ বিষয়ে গনমাধ্যমের সাথে কথা বলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। তিনি অবশ্য তার নির্বাচনী সভাকে কেন্দ্র করে কোন আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, "ফ্ল্যাগ আমার মন্ত্রীত্বের একটা পরিচয়। কিন্তু গাড়িটা আমার ব্যক্তিগত। এখানে আমি অন্য কোন বিশেষ সুবিধা নিচ্ছি না। এখানে আচরণবিধিও লংঘন হচ্ছে না।''
সভাস্থলে সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতির বিষয়ে অবশ্য কোন কিছু জানেন না বলেই দাবি করলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী।"আমি উনাকে এখানে ডেকে আনি নাই। উনি কেন এসেছেন সেটা জানি না। কিন্তু একজন মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের থাকে। তিনি হয়তো সে কাজেই এসেছেন। এতে কোন ভুল নেই। তিনি গণমাধ্যমকর্মীকে উল্টো প্রশ্ন করে বলেন,আপনি কী দেখেছেন আমি পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কোন পরামর্শ করেছি?''
যদিও বাস্তবতা ছিল, পুলিশের ওসি সেই সভায় বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করেছেন। এমনকি সভা থেকে বের হওয়ার পরও সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাকে।
নির্বাচনী বৈঠকে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতি এবং পরে বৈঠককালীন পুরো সময় অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে তার উপস্থিত থাকা নিয়ে কথা বললে নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সৈয়দুজ্জামানের সঙ্গে।

তিনি অবশ্য দাবি করলেন, অনুষ্ঠানস্থলে মন্ত্রীর উপস্থিত থাকার বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না। ন"আমি মন্ত্রী সাহেবের জন্য আসিনি। আমি এসেছিলাম মেয়র সাহেবের কাছে একটা কাজে। মন্ত্রী মহোদয় যে এখানে আসবেন, আমি সেটা জানতাম না।''
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই সভায় অংশ নিতে প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা এবং নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী শ্লোগানে আচরণবিধি ভঙ্গ হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত কোন মন্ত্রী বা অন্য কোন ভিআইপি ব্যক্তি তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল না করেন কিংবা দল থেকে মনোনয়ন না পাবেন ততক্ষণ তো তিনি প্রার্থী না। যখন প্রার্থী ঘোষণা হয়ে যাবে তখন কিন্তু তিনি ফ্ল্যাগ বা সরকারি গাড়ি কিংবা অন্য কোন সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না।''
যদিও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দল কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীরা আচরণবিধির আওতায় চলে আসেন। এই সময় থেকেই আচরণবিধি কার্যকর বলেই প্রচার-প্রচারণা, শোডাউন ইত্যাদি নিষিদ্ধ এবং এই সময়ে নির্বাচনী বৈঠকেও কেউ মন্ত্রীত্বের ফ্ল্যাগ বা অন্য কোন সরকারি সুবিধা নিতে পারেন না।

http://www.dailysangram.com/post/355279