২৯ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৭

খেলাপি ঋণে ব্যাংকের মুনাফা নামছে এক-চতুর্থাংশে

দেশে ব্যাংক ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে আর এতে ক্ষয় হচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা। অবলোপনসহ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে দেখানো হচ্ছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রায় ৮০ শতাংশই আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হয়েছে। আর কুঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে বেশি হারে। প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের আয় থেকে অর্থ এনে। এতে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নিট আয় আগের বছরের চেয়ে কমে যাবে। অনেক ব্যাংকই লোকসানে পড়বে বলেও জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বড় বড় কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু ওই ঋণের বেশির ভাগই পরিশোধ করা হচ্ছে না। আবার নানা কৌশলে তা কাগজে-কলমে আদায় দেখানো হচ্ছে। ফলে যেটুকু আদায় দেখানো হচ্ছে, তা প্রকৃত আদায় নয়। আবার যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে প্রকৃত ঋণ তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বলে ওই সূত্র দাবি করেছে। এ বিষয়ে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা সুখকর নয়। কারণ বেশির ভাগ ব্যাংকেই টাকার সঙ্কট চলছে। সেই সাথে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট। আগে ব্যাংকগুলো নানাভাবে জোড়াতালি দিয়ে মুনাফা দেখাতে পারত। এখন অনেক ব্যাংকের সে সুযোগও নেই। ফলে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই প্রকৃত অবস্থা ভালো হবে না।
ব্যাংকাররা জানান, ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে এক দিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিপরীতে কমে যাচ্ছে আদায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তিন মাসে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, খেলাপিরা ঋণ আদায় না করায় ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন নিয়মিত পরিশোধকারীরা। কারণ একজন ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে ব্যবসা করায় তার ব্যয় কমে যায়। অপর দিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদে আসলে পরিশোধ করায় তুলনামূলকভাবে অপর ব্যবসায়ীর ব্যয় বেড়ে যায়। এ অসম প্রতিযোগিতায় ভালো ব্যবসায়ী গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এভাবেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে আর ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র চার হাজার ২১০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকেরই প্রায় অর্ধেক। কিন্তু আদায় হয়েছে সবচেয়ে কম। যেমন ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জুন শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ৬১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা, শতকরা হিসেবে মাত্র ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৫৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার মধ্যে আদায় করেছে দুই হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, আদায়ের হার ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এভাবে ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা। বছর শেষে যে পরিমাণ পরিচালন মুনাফা দেখানো হচ্ছে খেলাপি ঋণের প্রভিশন সংরক্ষণ ও করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে তার তিন-চতুর্থাংশই চলে যাচ্ছে। ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো প্রকৃত মুনাফা থাকছে চার ভাগের এক ভাগ। এ বিষয়ে দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের আকৃষ্ট করতে ব্যাংকগুলো অনেকটা ঘটা করে তাদের পরিচালনা মুনাফা প্রচার করে। কিন্তু খেলাপি ঋণের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যায় তাদের মুনাফা। তিনি বলেন যে অবস্থা তাতে, বেশির ভাগ ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা পরিচালন মুনাফার চার ভাগের এক ভাগের নিচে নেমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে খেলাপি ঋণ গোপন করছে। একই সাথে আয় বাড়াতে হিসাবের নানা কারসাজি করছে। আর এতেই প্রভাব পড়ছে পরিচালনা মুনাফায়। কিন্তু প্রকৃত হিসেবে তা সমন্বয় করতে কমে যাচ্ছে প্রকৃত মুনাফা।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে হিসাবের কারসাজি করে থাকে। যেমনÑ খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। এটি আলাদা হিসাবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ আদায় হলে এর বিপরীতে আয় মুনাফা হিসাবে দেখাতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংক বার্ষিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে স্থগিত আয় মুনাফা হিসাবে দেখায়। অপর দিকে, মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ ‘পেয়েবল’ হিসাবে প্রভিশন করতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পেয়েবল হিসাবে রাখা টাকাকে আয় খাতে প্রদর্শন করছে। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভেবল’ হিসাবে টাকা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভেবল আয় হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কে আয় প্রকৃতপে না হলেও তা আয় হিসাবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বেশি দেখা যাচ্ছে মুনাফা। এভাবে মুনাফা বাড়াতে নানা কারসাজির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ ও মুনাফা তদারকি করতে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব গরমিল বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে গোপন করা আয় ও খেলাপি ঋণের একটি অংশ ধরা পড়ছে। আর এ ভাবেই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক। বিষয়টিকে ভালোভাবে নজরে নিয়ে ব্যাংকের মুনাফার জালিয়াতি বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যাংক বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, মুনাফার জালিয়াতি ঠেকাতে না পারলে ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় হয়ে যাবে। এর প্রভাব শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, পুরো অর্থনীতিতে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/368199