২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:১৩

গ্যাসের বর্ধিত মূল্য যাবে বাজেটের ঘাটতি পূরণ খাতে

* নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে

* ক্ষতিগ্রস্ত হবে সব ধরনের শিল্প খাত

এইচ এম আকতার: এক সাথে দুই ধাপে বেড়েছে আবাসিক গ্যাসের দাম। গ্যাস কেনায় ব্যয়বৃদ্ধির অজুহাতে বিভিন্ন খাতে গড়ে ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতির প্রতিটি খাতে। এতে বছরে গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে প্রায় চার হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। আর এ অর্থের পুরোটাই যাবে পেট্রোবাংলার অধীনে সৃষ্ট ‘সাপোর্ট ফর শর্টফল’ নামক নতুন এক খাতে। বর্ধিত অংশ পাবে না পেট্রোবাংলা এবং তার অধীন কোম্পানিগুলো। এ খাতের অর্থ কীভাবে বণ্টিত হবে, তা পরিষ্কার নয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,এই ব্যয়বৃদ্ধির কয়েক গুণ প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের ওপর। এ বৃদ্ধিতে শিল্প খাতকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গৃহস্থালি গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত বৃহস্পতিবার গ্যাসের দামবৃদ্ধির ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে সময় জারি করা প্রজ্ঞাপনে সাপোর্ট ফর শর্টফল খাতটির ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের মূল্যহার বণ্টন অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগস্টে যে হার ধার্য করা হয়েছিল, সেভাবেই অংশ পাবে পেট্রোবাংলা ও এর অধীন কোম্পানিগুলো। আর বর্ধিত দামের অর্থ যাবে সৃষ্ট নতুন খাতে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুতে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়ছে ৩৪ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে এক টাকা ২৬ পয়সা, সারে ১৩ পয়সা, শিল্পে এক টাকা দুই পয়সা, চা-বাগানে ৯৭ পয়সা, বাণিজ্যিকে পাঁচ টাকা ৬৮ পয়সা, সিএনজি ফিড গ্যাসে পাঁচ টাকা ও আবাসিকে চার টাকা ২০ পয়সা। এর পুরোটাই যাবে সাপোর্ট ফর শর্টফল খাতে। তবে এ খাতের অর্থ কীভাবে বণ্টিত হবে, তা পরিষ্কার নয়।

জানতে চাইলে বিইআরসির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাপোর্ট ফর শর্টফল খাতের অর্থ কীভাবে বণ্টিত হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এটি মূলত ঘাটতি অর্থায়নে ব্যবহৃত হবে। যেমন: গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলের মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। তারা বর্ধিত অর্থ পাবে এ খাত থেকে। আবার সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল কোম্পানির বিতরণ মার্জিনও বেড়েছে। শর্টফল খাত থেকে তারাও অর্থ পাবে। এছাড়া আইওসির কেনা গ্যাসের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ পেট্রোবাংলার ঘাটতি এ খাত থেকেই পূরণ করা হবে। তবে এজন্য কোনো নির্ধারিত হার এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছর গ্রাহকদের দুই হাজার ৮৭৭ কোটি ৬৫ লাখ ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করবে পেট্রোবাংলা। এ হিসাবে আগের মূল্যহারে গ্রাহকদের ব্যয় ছিল ১৮ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। তবে দুই ধাপে গড়ে এক টাকা ৪৫ পয়সা দাম বাড়ছে। ফলে গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে প্রায় চার হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। এতে পেট্রোবাংলা ও এর অধিভুক্ত কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ বাড়লেও সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গৃহস্থালি খাতে। এক্ষেত্রে দুই ধাপে একমুখো ও দ্বিমুখো চুলার বিল বাড়ছে যথাক্রমে ৫০ ও ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এতে খাতটির গ্রাহকদের ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ১৭২ কোটি টাকা। আর মিটারভিত্তিক আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ছে ৬০ শতাংশ। এ খাতের গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে বছরে ৭১৩ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে শুধু আবাসিক গ্রাহকদের ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বা ৪৫ শতাংশ। যদিও সরবরাহ করা গ্যাসের মাত্র ১৪ শতাংশ পাবে এ খাত। এছাড়া গ্রাহক পর্যায়ে সিএনজি ফিড গ্যাসের দাম দুই ধাপে বাড়ছে ১৪ শতাংশের বেশি। এতে ব্যয় বাড়বে ৬৬৯ কোটি টাকা বা ১৬ শতাংশ। অথচ পাঁচ শতাংশের কম গ্যাস সরবরাহ করা হয় এ খাতে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, আবাসিকে গ্যাসে দামবৃদ্ধি সরাসরি গ্রাহকদের বহন করতে হবে। আবার সিএনজি ফিড গ্যাসের দামবৃদ্ধির জন্য পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে। সব মিলিয়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়বৃদ্ধির কয়েক গুণ প্রভাব পড়বে সাধারণ জনগণের ওপর।

এদিকে শিল্প খাতের গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে ক্যাপটিভ, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দামবৃদ্ধির ফলে। এর মধ্যে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। এতে খাতটির উদ্যোক্তাদের ব্যয় বাড়বে ৫৭৯ কোটি টাকা। শিল্পে দুই ধাপে গ্যাসের দাম বাড়বে ১৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এতে ব্যয় বাড়বে ৪৫২ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম দুই ধাপে বাড়ছে ৫০ শতাংশ। ফলে এ খাতের গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে ১৫৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের পরিচালক (বিটিএমএ) খোরশেদ আলম বলেন, দেড় বছর আগে ক্যাপটিভের দাম শতভাগ বাড়ানো হয়েছিল। সেই ক্ষতিই এখনও পূরণ করা যায়নি। আবার বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্তত তিন বছরের ব্যবধান থাকা উচিত ছিল। তবে হঠাৎ এ ধরনের দামবৃদ্ধি শিল্প খাতকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম দুই ধাপে বাড়ছে ১২ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। এতে খাতটির গুাহকদের ব্যয় বাড়বে ৪২৫ কোটি টাকা। এ খাতের বড় গ্রাহক বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া বেসরকারি কিছু কেন্দ্রেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এ দামবৃদ্ধির প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এরই মধ্যে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা দিয়ে রেখেছে উৎপাদন ও বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।

এর বাইরে চা-বাগানে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম দুই ধাপে ১৫ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ বাড়ছে। এতে খাতটির গ্রাহকদের ব্যয় বাড়বে তিন কোটি টাকা। আর সার উৎপাদনে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ৫ দশমিক শূন্য চার শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে সার উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে ১৯ কোটি টাকা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বাড়বে। উৎপাদনকারীরা বাজারেও দাম বাড়িয়ে দেবে। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে পরিবহন খরচও যোগ হয়। অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচ বাড়বে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। গ্যাসের সংযোগ নিতে হয় স্বল্প-মধ্য-ধনী সব শ্রেণির মানুষের। আর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ গৃহস্থালি গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

 http://www.dailysangram.com/post/273633