২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:২৫

ফল-ফসলে হিটশকের শঙ্কা

বৈশাখের গনগনে রোদের কড়া তেজে ধরা মাঝে যেন সূর্যের আগুন গলে পড়ছে। দিনে-রাতে ঘরে-বাইরে কোথাও নেই স্বস্তি। বাতাসেও যেন আগুনের হল্কা। অন্তত চার সপ্তাহ ধরে অবিরাম খরা-অনাবৃষ্টির সাথে উচ্চ তাপদাহে মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। নদ-নদী-নালা-খাল শুকিয়ে তলানিতে বইছে ক্ষীণধারায়। ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে টানা প্রচন্ড তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টি-খরতাপে পাকা, আধাপাকা ইরি-বোরোসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফসল, ফল-ফলাদি, শাক-সবজিতে ‘হিট শকে’র আশঙ্কা করছেন কৃষক ও কৃষিবিদগণ। টানা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং খরা অনাবৃষ্টিতে হিটশকের শঙ্কা থাকে। হিট শকে আধাপাকা ধান চিটায় নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ফল ফলাদি অপরিপক্ক ও অপুষ্ট অবস্থায় পেকে যায় (অকালপক্ব)। এমনকি গুটি ঝরে পড়তে পারে।

চলমান মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে ইতোমধ্যে ফল-ফসল পুড়ে খাক ও বিবর্ণ হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। এ সময়ে বৃষ্টিপাতের বিকল্প নেই। কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টির দেখা নেই। গতকাল জুমার নামাজে ইমাম-খতিবগণ লাখো কোটি মুসল্লির সাথে আল্লাহর দরবারে রহমতের বৃষ্টির জন্য আকুল ফরিয়াদ করেছেন।

এদিকে আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) গতকাল শুক্রবার থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার জন্য পুনরায় হিট এলার্ট বা উচ্চ তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে। হিট এলার্ট বার্তায় আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, দেশের উপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায়ও (তিন দিন) অব্যাহত থাকতে পারে। সেই সাথে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বাতাসে অত্যধিক হারে জলীয়বাষ্প থাকায় গরমের তীব্রতায় জনজীবনে অস্বস্তি বাড়ছে। আবহাওয়া-জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, বাংলাদেশে উচ্চ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে চলতি সপ্তাহজুড়ে।

গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। গতকাল সমগ্র খুলনা বিভাগের জেলাসমূহ, রাজশাহী বিভাগের ব্যাপক অংশ ও ঢাকা বিভাগের আংশিক তাপমাত্রা ৩৯ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেছে। রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৪ এবং সর্বনিম্ন ২৮ ডিগ্রি সে.।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় সিলেটে ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি ছাড়া দেশের কোথাও বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, কোথাও কখনো শিলাবৃষ্টি, বজ্র-কালবৈশাখীর সাথে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন বর্ষণে সাময়িক স্বস্তি আসতে পারে। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে গরম আরও উসকে উঠে।
অব্যাহত উচ্চ তাপদহনে গরমে-ঘামে মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং ও বিভ্রাটে সারা দেশে ভোগান্তি অসহনীয়। গ্রীষ্মের কড়া তাপপ্রবাহে জ্বলছে চারদিকে গাছপালা, পশু-পাখি, প্রাণিকুল, পরিবেশ-প্রকৃতি, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। সর্বত্র বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার। দিন ও রাতে প্রচ- গরমে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে অনেকেই। সর্দি-কাশি, জ্বর-শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, হিটস্ট্রোক ও মূর্ছা যাওয়া, শরীরে পানিশূণ্যতাসহ নানাবিধ রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সেই সাথে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনজীবনে নানামুখী কষ্ট-দুর্ভোগ বহুগুণে বেড়েই চলেছে।

আজ শনিবার সহ আগামী ৭২ ঘণ্টার (তিন দিন) পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সমগ্র খুলনা বিভাগসহ বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলাসহ ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারী ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল সকালে ঢাকায় বাতাসে জলীয়বাষ্পের হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক বেশি। তাতে গরমে-ঘামে দ্রুত দুর্বল ও অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

পরবর্তী ২ থেকে ৩ দিনে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়বে। এর পরের ৫ দিনে আবহাওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে।

হিট শকের আশঙ্কা ও করণীয় : টানা অনাবৃষ্টি ও সেই সাথে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অব্যাহত থাকলে ফল ফসলে হিট শকের আশঙ্কা রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ যাবত দেশের উল্লেখযোগ্য এলাকায় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রিরও বেশি অবস্থান করছে।
এ অবস্থায় গ্রীষ্ম মৌসুমের এ সময়ে বিশেষত আধা পাকা ও অপরিপক্ক ও থোড় ধরা অবস্থায় ধানে হিট শকে চিটা ধরার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফলমূল বিশেষ করে আম, লিচু, আনারস, আতা, কাঁঠাল, লেবু প্রভৃতি প্রচণ্ড গরমে ও অনাবৃষ্টির কারণে ঝরে পড়তে পারে। অথবা অপরিপক্ক ও অপুষ্ট অবস্থায় পেকে যেতে পারে (অকালপক্ব)। ফল ফলাদি রসালো হয়ে উঠতে পারে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষিবিদদের সূত্রে জানা গেছে। ২০০৭ সাল, ২০২১ সালে তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টিতে হিট শকের কবলে ফল ফসলের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। টানা উচ্চ তাপপ্রবাহে হিট শক হলে ফল-ফসলে নতুন বিপদের শঙ্কা ডেকে আনে একথা জানায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিআরআরআই।

টানা দৈনিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সে. বা ততোধিক হলে ইরি-বোরো ধানে ‘হিট শকে’র আশঙ্কা করেন ইনস্টিটিউটের গবেষকগণ। এহেন তাপমাত্রা দেশের অনেক জায়গায় অবিরাম বিরাজ করছে।

গবেষকরা জানান, ধানের পরিপক্ক ও পুষ্ট হওয়ার পর্যায়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ধানের দানা গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে অর্ধপুষ্ট দানার সংখ্যা তথা চিটা বৃদ্ধি পায়। এতে ধানের ফলন ও গুণগত মান ব্যাহত হয়।

হিট শকের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে বিআরআরআই’র সতর্কতায় বলা হয়েছে, ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ফসলি জমিতে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। যেসব জমির ধান পরিপক্ব হয়নি সেখানে পানি ধরে রাখলে চিটা হবে না।

https://dailyinqilab.com/national/article/652196