৯ নভেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ৩:৩৩

রাজধানীতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংস্টার

এমন কোন মহল্লা নেই যেখানে এদের খুঁজে পাওয়া যাবে না

ক্রমশ : ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রাজধানীর কিশোর গ্যাংস্টারগুলো। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোর মুখগুলোর কেউ কেউ বিভিন্ন নামিদামী স্কুল-কলেজের ছাত্র, আবার কেউ অছাত্র ও গরিব ঘরের সন্তান। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, মহল্লার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়, উচ্চ গতি ও প্রচন্ড শব্দ করে মোটরসাইকেল বা গাড়ি রেসিং ও অশ্লীল ভিডিও শেয়ার এদের অন্যতম কাজ। এমনকি পান থেকে চুন খসলে খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে সরব হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাংস্টারগুলো এখন রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। রাজধানীর এমন কোন মহল্লা নেই যেখানে কিশোর গ্যাংস্টার গ্রুপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। 
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে ২ শতাধিকের মতো কিশোর গ্রুপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব কিশোর অপরাধীদের নজরদারি বা আটকের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে প্রত্যেক গ্রুপের টিম লিডারদের নাম, তাদের পরিবারের নাম - ঠিকানা সংগ্রহে কাজ করছে।
সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার জুরাইন এলাকায় ছোট বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিশোর গ্যাংস্টার গ্রুপের হাতে ছুরিকাঘাতে প্রাণ দিতে হয়েছে বড় ভাই শেখ ইসলাম পাভেলকে (২১)। গত ৪ নভেম্বর র‌্যাব-৩ এর একটি দল খিলগাঁও তালতলা এবং শাহজাহানপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্যাংস্টার গ্রুপ ‘রোড রাইডার্স’ ও ‘ক্রাস বিডি’- এর ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে তিনটি ব্যবহৃত গুলির খোসা, একটি প্রজেক্টাইল, একটি ডামি পিস্তল এবং পাঁচটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। 
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে কিশোরদের। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে তাদের কৌশলে যুক্ত করা হচ্ছে। এখনই অভিভাবক, শিক্ষক ও এলাকাবাসীসহ সব মহলকে সচেতন হতে হবে। না হলে নতুন এ প্রজন্ম পুরোপুরি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। যা সমাজে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
শ্যামপুর থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, শেখ ইসলাম পাভেল হত্যা মামলায় উল্লেখ করা মাসুম, তুহিন, রাব্বি ও ইরফান জুরাইন এলাকার কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপ গ্যাংস্টারের সদস্য। রাস্তায় মেয়েদের একা পেলে উত্ত্যক্ত করা, রাতে শিক্ষার্থীদের বাসার আশপাশে ওৎ পেতে থেকে জানালা দিয়ে টর্স লাইট বা লেজার লাইট মেরে বিরক্ত করা ও স্কুল কলেজের সামনে হর্ন বাজিয়ে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে সবার নজর কাড়াই এদের কাজ। এ ছাড়া উঠতি বয়সেই ছিনতাই, মাদক কারবার ও মহল্লায় মাস্তানিতে জড়িয়ে পড়ছিল তারা। তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। 
র‌্যাব ৩ এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, গ্যাং কালচারের নামে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে উঠতি তরুন-কিশোররা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, বখাটেপনা, হিরোইজম ও থ্রিল থেকে এসব কিশোর ছিনতাই, মাদক বানিজ্য, মাদক বহন, মাদক সরবরাহকারি, মাস্তানি, দাদাগিরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এদের বিষয়ে অভিভাবকদের এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় অপরাধে জড়িয়ে পড়বে উঠতি বয়সের ওই ছেলেরা। 
খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মনসুর আলী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমার ছেলে নটরডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অনেক সময় সন্ধ্যার পর বাইরে গিয়ে আড্ডা দেয় বন্ধুদের সাথে। ওই বন্ধুদের অনেকেই বেপরোয়া চলাফেরা করে। ছেলেকে বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করতে পারছি না। এ জন্য সবসময় ভয়ে থাকি, কখন কি হয়ে যায়। তিনি বলেন, ওর দু’বন্ধুর বিরুদ্ধে এলাকার দোকান থেকে খাবার কিনে টাকা না দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিঘ্ন। আমাদের মতো অনেক অভিভাবক, পিতা-মাতা সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন। আমাদের একটাই ভয় ছেলেরা যে বন্ধুদের সাথে চলে তাদের চলাফেরার গতি ভিন্ন। সবসময় দুঃশ্চিন্তা হয় বলে মনসুর আলী জানান। 
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় কিশোর জিয়াউল হক অনিককে। অনিক হত্যাকান্ডের নেপথ্যেও ছিল গ্যাং কালচার। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। শুধু অনিক নয়, গ্যাং কালচারের বলি হতে হয়েছে এখন পর্যন্ত অনেক কিশোরকেই। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে স্কুলছাত্র আদনান কবিরকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে কয়েক কিশোর। এ মামলার তদন্তে বের হয়ে আসে কিশোর-তরুণদের ‘গ্যাংকালচার’-এর ভয়ঙ্কর কাহিনী। চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের হামলায় রূপনগরে খুন হয় কামাল হোসেন নামে এক কিশোর। ১৮ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় খুন হয় কিশোর আবদুল আজিজ। ১ জুলাই আদাবরের শেখেরটেক এলাকায় সজল (১৫) নামে এক টেইলার্স কর্মীকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে তার বন্ধুরা। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্ধে ২৫ আগস্ট দারুসসালামের টোলারবাগে ছুরিকাঘাতে খুন হয় শাহিন (১৬)। ১৩ আগস্ট মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়বিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ কিশোররা। এর এক মাস পর অক্টোবরে খুন হয় তিন কিশোর। ৬ অক্টোবর কদমতলীর রায়েরবাগের মুজাহিদনগর এলাকায় খুন হয় রফিকুল ইসলাম, ৮ অক্টোবর রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডিতে খুন হয় ইরফান, ২৮ অক্টোবর ভোরে জুনিয়র-সিনিয়র দ্বন্ধে প্রতিপক্ষের হামলার একদিন পর মারা যায় হাসান আলী নামে এক স্কুলছাত্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কেউ কেউ এলাকায় টিকে থাকতে এসব গ্যাংয়ে যুক্ত হয়। আবার কেউ কেউ এলাকায় দাপট দেখাতে বা ‘হিরোইজম’ প্রবণতা থেকেও যুক্ত হচ্ছে। দুটি গ্যাংই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।
নিয়ন্ত্রণের ধরন কী, জানতে চাইলে এসব শিক্ষার্থী জানান, কখনো একটি দলের পাল্লা ভারী থাকে। যেই দলের পাল্লা ভারী থাকে সেই দলের ছেলেরা তখন বড় ভাই। তারাই খেলার মাঠের নিয়ন্ত্রণ, মোটরসাইকেল রেস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। রাস্তায় রোমিওগিরিও করে। তখন আরেক দল নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে এবং এ থেকে মারামারি, খুনখারাবিও হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে কিশোর অপরাধ। এখনই সময় এসব গ্রুপ বা গ্যাংয়ের সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া ও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। নয়তো প্রতি মাসেই দু-একটা ঘটনা ঘটবে, প্রাণহানি হবে অথবা কেউ আহত হবে।
তিনি বলেন, আমাদের অভিভাবক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একটা অংশ এর জন্য দায়ী। আজকাল অভিভাবকরা সন্তানদের খোঁজ-খবর রাখেন না, যে কারণে তারা যে বখে যাচ্ছে সেটা নজরে আসে না। তাই সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারাও এর জন্য কম দায়ী নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটা অংশ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে অল্পবয়সী ওই কিশোরদের শেল্টারের দায়িত্ব নেন। যে কারণে তারা ভয়ঙ্কর অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
রাজধানীর মানিকনগর পুকুরপাড় এলাকার এক বাসিন্দা গতকাল বলেন, গলিতে গলিতে কিশোর অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ অপরাধীদের জন্য এখন মানুষ ওই এলাকার রাস্তায় নামতেও ভয় পান। পুকুর পাড়ের কয়েকটি স্থানে তাদের আড্ডা বলে স্থানীয় সূত্র বলেছে।
সেগুন বাগিচা এলাকার কাওসার নামে এক বাসিন্দা বলেছেন, কয়েকটি স্থানে এ কিশোর অপরাধীদের আড্ডা। বিশেষ করে সেগুন বাগিচা স্কুলের গলি, কাঁচাবাজারের পাশের গলি এবং শিল্পকলা একাডেমির উল্টো পাশের গলিগুলোতে তাদের আড্ডা। স¤প্রতি এ এলাকায় কিশোর অপরাধীরা একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটিয়েছে। 
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে বখাটেপনায় মেতে উঠছে অনেক কিশোর। এরা এখন এলাকার আধিপত্য বিস্তার লড়াইয়ে লিপ্ত রয়েছে। আবার অনেকে ছাত্রলীগের নাম দিয়ে নগরীর পাড়ায়-মহল্লায় কিশোর ও বখাটে গ্যাং বানিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করছে। শুধু নিজেদের মধ্যে হানাহানি নয়, নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় কিশোর অপরাধীদের উৎপাত বেড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় তুচ্ছ ঘটনায় সদলবলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হয় কিশোর সন্ত্রাসীরা। এদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে খুনের ঘটনাও। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে কিংবা শীর্ষ রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনুচর হিসেবে কাজ করছে অনেক কিশোর। যে যত ভয়ঙ্কর, তার হাতেই উঠে আসছে তত উন্নতমানের অস্ত্র। বিভিন্ন মহল্লায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি থেকে শুরু করে ছিনতাই-রাহাজানির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে এরা। নগরীতে নৃশংস খুনও সংঘটিত হচ্ছে কিশোর অপরাধীদের হাতে ।

https://www.dailyinqilab.com/article/164608/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AD%E0%A7%9F%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%89%E0%A6%A0%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0