৮ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ২:২৯

ইয়াবা মানুষকে পাগলে পরিণত করে

সব মাদককে ছাপিয়ে গেছে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার ব্যবহার। একসময় ফেনসিডিলের ব্যবহার বেশি থাকলেও ইয়াবার ধারে কাছেও ছিল না সেটি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে মাদকসেবীদের মধ্যে ৭০ ভাগেরও বেশি ইয়াবা আসক্ত। অথচ এ ইয়াবা এমন একটি মাদক, যা মানুষকে শুধু মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেয় না। মৃত্যুর আগে ওই ইয়াবাসেবীকে পাগলে পরিণত করে ফেলে। প্রাথমিকভাবে ইয়াবার এই ভয়ঙ্কর রূপ কেউ বুঝতে পারে না। এমনকি সেবনকারী নিজেও বুঝতে পারেন না যে তার শরীর ও মন কোন দিকে যাচ্ছে। একপর্যায়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে শুধু সেবনকারী নয়, সেবন না করেও তার পুরো পরিবার ইয়াবার যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর এমন প্রমাণ পেয়েছেন মাদক বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘বারাকা’র মাদকাসক্ত গবেষক জাকিউল আলম মিলটন বলেন, প্রতিটি মাদকই মানব দেহের জন্য ক্ষতির। মাদক মানেই মৃত্যু। মাদক সেবনকারী ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু ইয়াবা এমন একটি ভয়ঙ্কর মাদক যা মানুষকে শুধু মেরেই ফেলে না, মারার আগে ওই মানুষকে পাগলে পরিণত করে। যার পাগলামীর কারণে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি বলেন, মেথাঅ্যামফেটামিন, সুডোএফিড্রিন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় ইয়াবা। তবে প্রস্তুতভেদে এই মূল উপাদানগুলোর তারতম্য ল করা যায়। কোনো কোনো ইয়াবা ট্যাবলেটে ৯৫ ভাগ ক্যাফেইন, স্বল্প পরিমাণে মেথাঅ্যামফেটামিন ও সুডোএফিড্রিন থাকে।

প্রাথমিকভাবে এই ইয়াবা শরীরে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। মন থেকে ভয়ভীতি দূর করে; যে কারণে সে বুঝতে পারে না কী করবে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। একসময় ভয়ঙ্কর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব সব থেকে বেশি থাকে। একটি কাজ করলে পরে তার ফল কী হবে সেটি ভাবে না। একপর্যায়ে ইয়াবা সেবনকারী ধীরে ধীরে তার পাশে একটি অবাস্তব জগৎ তৈরি করতে থাকে। কল্পনায় সে তার চার পাশের মানুষদের শত্রু ভাবতে শুরু করে। আত্মীয়স্বজন, ভাইবোন, স্ত্রী, স্বামী-সন্তান, বাবা-মা সবাইকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। একপর্যায়ে ইয়াবা সেবনকারী নিজেকেও শত্রু ভাবতে শুরু করে। সে তখন অদৃশ্য শব্দ শুনতে পায় এবং অদৃশ্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তু দেখতে পায়। তার কাছে মনে হয় তার নিজের ছবিই তাকে হত্যা করবে। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না সে। এমনকি নিজেকেও না। এসব ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে সে পাগলে পরিণত হয়। তিনি বলেন, যেকোনো মাদকই মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়; যে কারণে স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে না। তবে এটি হয় যখন ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত থাকে। কিন্তু ইয়াবার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। ইয়াবা সেবন করতে করতে একপর্যায়ে সব সময়ের জন্য ওই ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অন্য মাদকে যে ঝিমুনি বা ঘুম ঘুম ভাব কাজ করে (যেমন- হেরোইন, মদ, ফেনসিডিল, গাঁজা) তা ইয়াবার ক্ষেত্রে হয় না। ইয়াবাসেবীরা বলে থাকে- ‘এটির মধ্যে কোনো আনন্দ বা সুখানুভূতি নেই’। যদি কোনো সুখানুভূতি বা আনন্দ না-ই থাকে তাহলে কেন মাদকসেবীদের মধ্যে ৭০ ভাগ ব্যক্তি ইয়াবা সেবন করছে- জানতে চাইলে জাকিউল আলম মিলটন বলেন, ইয়াবা সেবনে শরীরে উদ্যম, উদ্দীপনা, গতি, কর্মস্পৃহা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়। শারীরিক এসব পরিবর্তনের পাশাপাশি একজন ইয়াবাসেবী মানসিকভাবে এ মাদকের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইয়াবা সেবনে মানসিকভাবে যেসব প্রাপ্তি হয় বলে একজন ব্যক্তি মনে করে, তা মানুষের খুবই মৌলিক চাওয়া। যেমন মানুষ চায় সে হবে আত্মবিশ্বাসী। কথায়, মেলামেশায় ও আচরণে সে হবে অন্য আর দশ জনের থেকে চটপটে ও বেপরোয়া। অন্যরা যা সহজে করতে পারে না, তা সে অবলীলায় করে ফেলতে পারবে। সে হবে সব কিছুতে ব্যতিক্রম; হবে দ, সচেতন ও মনোযোগী। তার বুকের পাটা হবে অনুকরণীয় ইত্যাদি। সব মানুষের মধ্যেই কিছু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকে। ইয়াবার রাসায়নিক প্রভাব সাময়িকভাবে এ দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতগুলো কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল শক্তি চিরদিনের জন্য তিগ্রস্ত করে ফেলে।

এ ছাড়াও মানুষের অনেক আকাক্সক্ষা ও চাওয়া ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ এবং আইনকানুনের কারণে সে শিশুকাল থেকে অবদমন করে রাখে। এই অবদমিত কামনা ও বাসনাচরিতার্থ করার জন্য ইয়াবা তাকে বেপরোয়া ও দুঃসাহসী করে তোলে। ইয়াবায় কোনো ধরনের সুখানুভূতি না থাকার পরও এসব মৌলিক চাওয়া-পাওয়া পূরণের একটি কাল্পনিক ও অবাস্তব উপায় হিসেবে তরুণ মাদকসেবীরা ইয়াবা সেবন করে যাচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/363043