৮ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ২:২১

বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিয়ে নতুন সঙ্কট

প্রাথমিকের বই ছাপা কাজের শেষপর্যায়ে বিশাল জটিলতা ; পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আজ মন্ত্রী যাচ্ছেন এনসিটিবিতে ; তাৎক্ষণিক সমাধান চেয়ে এনসিটিবিকে মুদ্রণ শিল্প সমিতির চিঠি

বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে নতুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সঙ্কটের আশু ও তাৎক্ষণিক সমাধান না হলে সময়মতো পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়ে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বিনামূল্যের পাঠ্যবই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন লক্ষ্যমাত্রা এক মাস পিছিয়ে ৩০ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) তথ্যানুযায়ী সারা দেশে বই পৌঁছেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তুপ্রকৃতপক্ষে উপজেলাপর্যায়ে বই পৌঁছেছে মাত্র ৫২ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য ছাপার আদেশ দেয়া ৩৬ কোটি ছয় লাখের বেশি বইয়ের মধ্যে এনসিটিবির তথ্যানুসারে অবশিষ্ট ২০ কোটি বা ৪০ শতাংশ বই কবে ছাপা হবে, কখন সেগুলো উপজেলাপর্যায়ে বা বিদ্যালয়ে পৌঁছাবে না নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বই ছাপার জন্য কাগজ সঙ্কট, পরিবহন সমস্যাসহ নানা কারণে অবশিষ্ট বই ছাপা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির অভিযোগ এনসিটিবি পাঠ্যবই ছাপার কাজ মনিটরিং, সরবরাহ অনুমোদন এবং পরিবহনে অসহযোগিতা ও বাধা সৃষ্টি করছে।

এনসিটিবি ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক সূত্র জানায়, সময়মতো বিল না পেলে এবং মিলগুলো ওয়াদা মতো কাগজ সরবরাহ না করলে মাধ্যমিকের বই ছাপা ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল সকালে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়ে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান চাওয়া হয়েছে বলে সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত জানান। অপর দিকে আজ এনসিটিবিতে আসছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি পাঠ্যবইয়ের ছাপা ও বিতরনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি জানান, মন্ত্রী এনসিটিবি পরিদর্শন করতে এলে আমরাও তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করব।

এনসিটিবিকে চিঠি দেয়ার কথা স্বীকার করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি গতকাল নয়া দিগন্তকে আরো বলেন, এনসিটিবি কিছু অনাহূত সমস্যা সৃষ্টি করছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য লিখিতভাবে এনসিটিবিকে জানানো হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এনসিটিবি বই ছাপার কাছে যতটুকু সহায়তা করেছে এবার ঠিক ততটুকুই অসহযোগিতা পেয়েছি।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, মন্ত্রী এনসিটিবি আসবেন এটা তার রুটিন ওয়ার্ক। পাঠ্যবই নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সময়মতোই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে যাবে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির চিঠি সম্পর্কে তিনি বলেন, চিঠিতে কি লেখা আছে এখনো দেখিনি। এটা ফাইল নোট হয়ে আমার কাছে আসবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, ভারতীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাওয়া এনসিটিবির মনিটরিং টিমের প্রতিবেদন দিয়ে কী হবে? তাদের ৫৬ লাখ বই ইতোমধ্যে উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অবশিষ্টগুলো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দেশে পৌঁছবে, ফলে সে বই নিয়ে কোনো টেনশন নেই।

এনসিটিবি একাধিক সূত্র ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষপর্যায়ে রয়েছে। অবশিষ্ট বই ছাপার জন্য এখন কাগজ ও এনসিটিবি থেকে বিল পাওয়া সাপেক্ষে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা গেলেই মাধ্যমিকের কাজে হাত দেয়া হবে। অন্যথায় মাধ্যমিকের বই মুদ্রণ করছে না টেন্ডার পাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, ঢাকা, রাজশাহী ও বগুড়ার সাতটি বড় প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত একটি বইও দেয়নি। তারা বিল না পাওয়ায় বই ছাপার কাজ কমিয়ে দিয়েছে। তারা বলেন, কাগজ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে, বিলের টাকা দিচ্ছে না এনসিটিবি। বই ছাপা হলেও পরিবহন সঙ্কটের কারণে আগে একাধিক লট পথে পথে আটকে ছিল। এখন আবারো রাস্তায় বই পড়ে থাকলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে।

জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে বই ছাপা ও মনিটরিংয়ে এনসিটিবি সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল। কিন্তু এ বছর শুরু থেকেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে দেশীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ছাপাখানাগুলোতে এনসিটিবি মনিটরিং টিম পরিদর্শনে গেলেও কাগজের ও ছাপার মানের অনুমোদন নানা ছুতায় বিলম্ব করা হচ্ছে। এর ফলে ছাপার কাজ শেষ করতে পারছে না মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এরূপ বেশ কিছু সুস্পষ্ট অভিযোগ এনসিটিবিতে দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একই ধরনের অভিযোগ পাঠ্যবই সরবরাহের এবং পরিবহনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে এনসিটিবি এসব কাজে সহায়তার পরিবর্তে হয়রানি করছে।

মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানান, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বই পরিবহনে পুলিশের নানা ধরনের হয়রানির ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু এবার তা করা হয়েছে গত তিন দিন আগে। ফলে বই পরিবহনকারী ট্রাক-ভ্যানগুলো পথে পথে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়েছে। ফেরিতে দুই-তিন দিন বিলম্ব ও লাইনে পড়ে থাকতে হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ফেরিতে অগ্রাধিকার পেয়েছিল বই পরিবহনকারী ট্রাক-ভ্যান। এবার তার বিপরীত ঘটছে।

এ ছাড়া সম্প্রতি চার দিনের পরিবহন ধর্মঘটের ফলে, মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের বই ছাপা কাগজ সংগ্রহ এবং ছাপা বই পৌঁছানোর সব কার্যক্রম আট দিন পিছিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি কোনো ধরনের কথাই শুনছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, এনসিটিবি মুদ্রণকারীদের সব ধরনের সহায়তা আগের মতোই করছে। কোনো ধরনের সমস্যার কথা জানার সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমাধানের সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/363023