৭ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১১

আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ ও সংলাপ

॥ ইকতেদার আহমেদ ॥

বাংলাদেশের জনমানুষ ‘সংলাপ’ শব্দটির সাথে বেশ পরিচিত। সংলাপের মাধ্যমে দু’টি বিরোধী মতাবলম্বী পক্ষ সমঝোতায় উপনীত হতে পারলে সংলাপ সফল হয়, অপর দিকে সমঝোতায় উপনীত হতে না পারলে সংলাপ ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের প্রয়াস নেয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। সংলাপের বিফলতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গণপরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে যে সংলাপ হয়েছিল তাতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতার কাছে সরকার পরিচালনার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হয়। এ আলোচনা চলমান থাকাবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক অভিযান পরিচালনা করে নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর সংলাপের এই বিফলতায় সশস্ত্র পন্থায় মুক্তি তথা স্বাধীনতার পথে এ দেশের মানুষ অগ্রসর হয়। বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপ্তিকাল ছিল ৯ মাস। ভারত-পাকিস্তান সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের জন্মের পর এক বছরের মাথায় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রের সংবিধান কার্যকর হয়। ’৭২-এর সংবিধানে জাতীয় সংসদের নির্বাচনবিষয়ক যে বিধান ছিল তাতে বলা ছিলÑ মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে গেলে মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে মেয়াদ অবসানের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিধানটি কার্যকর থাকাকালে সংসদের ছয়টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছয়টি নির্বাচনের কোনোটির ক্ষেত্রেই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার কারণে মেয়াদ অবসানজনিত কারণে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। উল্লেখ্য, সংসদের সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ আপনা আপনি ভেঙে যায়। উপরি উক্ত ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য পাঁচটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ সংসদ অনুষ্ঠানের সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের সময় জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল। দলীয় সরকারের অধীন উপরি উক্ত পাঁচটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারই বিজয়ী হয়।
এ দেশের বড় দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনড় হলেও প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকাকালে দেখা গেছে উভয়েই দলীয় সরকার বহির্ভূত সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল ছিল।
দীর্ঘদিন ধরে এ বড় দু’টি দলের মধ্যে যে রাজনৈতিক বিরোধ তা হলো একটি সরকারের মেয়াদ অবসানের পরে কোন ধরনের সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেটি। এক সময় আওয়ামী লীগের দাবি পূরণ করে বিএনপি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে এ বিরোধটির সুরাহা করেছিল। কিন্তু পরে বিরোধী দল ও জনমতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে ব্যবস্থাটি রদ করে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন করে।
তিন জোটের রূপরেখার আলোকে কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করে। এ দাবিতে এ তিন দল ১৭২ দিন হরতাল-অবরোধ পালনকালে সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।

পঞ্চম সংসদ বহাল থাকাকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে তৎকালীন কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াকুর এমেকা ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিÑ এ দু’টি দলের নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে সংস্থাটির মধ্যস্থতায় আনুষ্ঠানিক সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। উভয় নেত্রী সংলাপের প্রস্তাবে সম্মত হলে মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ান নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল থেকে পাঁচজন করে সর্বমোট ১১ সদস্যের নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। সে প্রস্তাবে বিএনপি সম্মতি জ্ঞাপন করে আর আওয়ামী লীগ অসম্মতি ব্যক্ত করে। এর ফলে তার এ সংলাপের প্রয়াস ব্যর্থ হয়।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন এ দেশে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রথমটিতে আওয়ামী লীগ এবং শেষেরটিতে বিএনপি বিজয়ী হয়। অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসানের পরে কর্মরত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল সেটি এ সরকার গঠন বিষয়ের সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে গঠন করায় এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নরের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগের সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান সম্মত ছিল না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক আপিল মামলার রায়ে একজন বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার অবতারণা করে এটির কার্যক্রমকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস নেন। সাংবিধানিক বৈধতার অনুপস্থিতিতে এ ধরনের অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত বৈধতার আইনগত ভিত্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক জনস্বার্থে নিরসন হওয়া জরুরি।

অষ্টম সংসদ বহাল থাকাবস্থায় জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো দুই দফায় ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে সংলাপে বসে নির্বাচনকালীন সরকারবিষয়ক রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগ নেন। সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে তিনি সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট হলেও শেষ দফায় তার বিদায়কালে সাংবাদিকদের আক্ষেপের সুরে বলেন, বড় দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি পরস্পরের প্রতি যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করে সে ক্ষেত্রে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান আশা করা কঠিন। নিজ দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সে দেশের রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের এক টেবিলে বসানো ছাড়া তার সংলাপের আর কোনো সফলতা নেই।
অষ্টম সংসদ বহাল থাকাকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে উভয় দল কয়েক দফা সংলাপে বসে নির্বাচনকালীন সরকারবিষয়ক সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। এ সংসদের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধানের মধ্যে সংলাপ বিষয়ে টেলিফোনে কথোপকথন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে আনুষ্ঠানিক রূপ পেতে ব্যর্থ হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় এটি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা ছিল। উভয় নির্বাচন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক না হলেও প্রথমটির সাথে শেষেরটির পার্থক্য হলো, প্রথমটিতে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে এর বিলুপ্তি ঘটায়, অপর দিকে শেষোক্তটি অনুষ্ঠানের সময় আওয়ামী লীগ এটিকে নিছক নিয়ম রক্ষা ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন বলে উল্লেখ করে অচিরেই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানায়। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দলটি পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে এসে এ সংসদের মেয়াদ পূর্ণ করার দিকে অগ্রসর হয়।

দশম সংসদ নির্বাচনে একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এ সংসদের গঠন সংবিধানসম্মত কি না জনমনে এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়।
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন নিজেদের অধীন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলেও দলটি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অন্তর্ভুক্তিতে যে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে এর সাথে সংলাপ অনুষ্ঠানে সম্মত হয়েছে। সংলাপ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান বরাবর যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে তাতে সংবিধানসম্মত পন্থায় সমস্যা নিরসনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান একটি আইন। অপরাপর আইনের সাথে সংবিধানের পার্থক্য হলো এটি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশোধনযোগ্য। পক্ষান্তরে অপরাপর আইন সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশোধনযোগ্য। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবির বাস্তবায়নে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। অপর দিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দাবির বিপরীতে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হতে সরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এ দেশের জনমানুষের কাছে অজানা নয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঐক্যফ্রন্টের সাথে যে সংলাপে সম্মত হয়েছে এর সাফল্য পুরোপুরি নির্ভর করছে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে দলটি কতটুকু আন্তরিক তার ওপর। সংবিধানের বিদ্যমান বিধানাবলির আলোকে অথবা সংবিধান সংশোধন করে বর্তমান যে সঙ্কটে জাতি নিপতিত এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব। জাতির প্রয়োজনে ইতোপূর্বে একাধিকবার সংবিধান সংশোধনের নজির রয়েছে। যে নির্বাচন দেশের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তার পথে অন্তরায় এমন নির্বাচনের পথে অগ্রসর না হওয়াই ভালো। অপর দিকে যে নির্বাচন দেশকে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি দেবে সে দিকে অগ্রসর হওয়াই শ্রেয়। দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থায় নাকি সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে তা সংলাপের মাধ্যমে নিরসন করে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো একই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটি করা গেলে জাতীয় সংসদের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ ও জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হবে না। আর তাই ভবিষ্যতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির আশায় যেকোনো ধরনের অশ্চিয়তা পরিহার করাই উত্তম।
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/362846