২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৮:১৬

বিদেশে ট্রেনিংয়ের নামে কর্মকর্তাদের আনন্দ ভ্রমণ

আইন কর্মকর্তা অংশ নেন যান-যন্ত্রপাতি পরিচালনার ট্রেনিংয়ে * হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পরিদর্শন করেন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট

ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট দেখতে বেলারুশ সফর করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম। আর এলইডি প্রস্তুতকারক ফ্যাক্টরি দেখতে চীন সফর করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সিস্টেম এনালিস্ট আবু তৈয়ব রোকন। এ দুই কর্মকর্তার দায়িত্বের সঙ্গে বিদেশ সফর কোনোভাবেই মানানসই নয়। কারণ তারা টেকনিক্যাল ব্যক্তি নন। তারপরও তারা এ ধরনের সফর করেছেন। এ সফর থেকে সিটি কর্পোরেশনের কোনো লাভই হয়নি। তাদের সফর স্রেফ আনন্দের।
শুধু এই দুই কর্মকর্তা নন, দুই সিটি কর্পোরেশনের বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে হরহামেশাই এমন ঘটনা ঘটছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফরের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু এই দুই সংস্থায় বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। প্রেষণে নিয়োজিত সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে বেশি সুবিধা গ্রহণ করছেন। সফরের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল, নন-টেকনিক্যাল বিষয় বিবেচনায় রাখা হচ্ছে না। এছাড়া প্রতিটি সফর শেষে একটি অভিজ্ঞতা প্রতিবেদন জমা দেয়ার অনুশাসন থাকলেও কোনো কর্মকর্তা তা করছেন না। যার ফলে রাজধানী শহরের সেবাদানকারী প্রধান এ দুই সংস্থায় সরকারি বিদেশ সফর এক ধরনের আনন্দ ভ্রমণে পরিণত হয়েছে।
২০১৬-২০১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ এই দুই অর্থবছরের বিদেশ সফর সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত দুই অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ২৫৫টি অফিস আদেশে পেশাগত অভিজ্ঞতা অর্জনসহ নানাবিধ কারণে ৩৪৪ বার বিদেশ সফর করেছেন কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ডিএনসিসির ৭৬টি অফিস আদেশে ১৫৪ বার বিদেশ সফর হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত খরচে কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করেছেন ৮ বার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খরচে বিদেশ সফর করেছেন ৪৫ বার। আর ৫০ বার বিদেশ সফর করেছেন আয়োজক সংস্থার খরচে।
এর বাইরে ডিএনসিসির নিজস্ব তহবিলের বরাদ্দ, সরকারি ট্রেনিং, বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে বিদেশ সফর হয়েছে ৫১ বার। ডিএনসিসিতে সর্বোচ্চ ১১টি দেশ সফর করেছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহুল ইসলাম। এর মধ্যে ৬টি সফর টেকনিক্যাল সংক্রান্ত কাজে। আর পাঁচটি সফর নন-টেকনিক্যাল সংক্রান্ত কাজে। আর ডিএসসিসির ১৭৯ জন কর্মকর্তা ১৯০ বার বিদেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে ৬৩ বার বিদেশ সফর করেছেন ব্যক্তিগত খরচে। আর ৭৩ বার বিদেশ সফর হয়েছে আয়োজক সংস্থার খরচে। আর ৪১ বার বিদেশ সফর হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খরচে। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্প, সরকারি খরচ এবং বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে বিদেশ সফর হয়েছে ১৩ বার। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সর্বমোট ১৩ বার বিদেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে ৭ বার টেকনিক্যাল কারণে বিদেশ সফর করেছেন। আর অন্য সফরগুলো ব্যক্তিগত ও নন-টেকনিক্যাল কারণে।
ডিএনসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (অঞ্চল-৫) এসএম অজিয়র রহমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। তিনি চলতি বছরের ৯-২৯ এপ্রিল ‘বিল্ডিং স্মার্ট সিটিজ আন্ডার দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নেন। চীন সরকারের খরচের এ সফর কোনো প্রকৌশলীর হওয়ার কথা ছিল। সম্প্রতি বরিশালের ডিসি হিসেবে তার বদলির আদেশ হয়েছে।
নন-টেকনিক্যাল হয়েও টেকনিক্যাল সেমিনারে অংশগ্রহণের বিষয়ে এই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি সঠিক বলেছেন। ওই সেমিনারটি টেকনিক্যাল সেমিনার ছিল। অফিস আমাকে মনোনীত করায় আমি সেখানে অংশগ্রহণ করি।’ এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. জামাল মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিএনসিসির বিদেশ সফর সংক্রান্ত বিষয়গুলো খোঁজখবর করে দেখব। আর কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে সেগুলো বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করব।’
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিএসসিসির বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। যদি কোনো ধরনের অনিয়ম পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
নন-টেকনিক্যাল হয়েও যারা টেকনিক্যাল সফর করেছেন : ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়রের একান্ত সচিব ও প্রধান সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবরাউল হাছান গত বছরের ৪-১১ এপ্রিল চীন সফর করেছেন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির প্ল্যান্ট দেখার জন্য। তিনি চলতি বছরের ২০-২৪ ফেব্র“য়ারি ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে থাইল্যান্ড সফর করেন। ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেসবাহুল ইসলাম চলতি বছরের ২০-২৮ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়া যান ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ফুটপাত উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার জন্য।
তিনি গত বছরের ৪-১১ এপ্রিল ফিলিপস কোম্পানির ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে থাইল্যান্ড ও চীন সফর করেন। তিনি গত বছরের ৬-১২ নভেম্বর ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে জাপান সফর করেন, ২০১৬ সালের ২-৫ নভেম্বর ফিলিপস কোম্পানির ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে ইংল্যান্ড যান, একই বছরের ২০-২৬ নভেম্বর ফ্যাক্টরি মেইনটেন্যান্সবিষয়ক ট্রেনিংয়ে কোরিয়া সফর করেন। গত বছরের ২-৮ জুলাই প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকাবস্থায় যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাশিয়াও সফর করেন তিনি।
প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম গত বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে থাইল্যান্ড এবং চলতি বছরের ২০-২৮ অক্টোবর ক্ষতিগ্রস্ত সড়কবিষয়ক ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। আইন কর্মকর্তা এসএম মাসুদুল হক গত বছরের ১৯-২৫ কোয়ালিটি নিশ্চতকরণের উদ্দেশ্যে চীন সফর করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার গত বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড সফর করেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজুল আলম সুমন চলতি বছরের ২-৪ এপ্রিল পানির ব্যবহার ও মেইনটেন্যান্সবিষয়ক ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে ভারত সফর করেন। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, অঞ্চল-১ এর এসএম অজিয়র রহমান চলতি বছরের ৯-২৯ এপ্রিল শহরের স্মার্ট বিল্ডিং নির্মাণ বিষয়ক সেমিনারে অংশ নিতে চীন সফর করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলাল গত বছরের ১৩-১৮ নভেম্বর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। নির্মাণ কাজের মান যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গত বছরের ১৫-২৩ ডিসেম্বর চীন সফর করেন। গত ৭-১২ মে সিগন্যালে রিমোট কন্ট্রোল তৈরি ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে ভারত সফর করেন তিনি।
প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন ২০১৬ সালের ১৭-২২ ডিসেম্বর বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে জাপান সফর করেন। ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খান মো. নাজমুস শোয়েব গত বছরের জানুয়ারিতে যান-যন্ত্রপাতির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে ইতালি সফর করেন। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল গত বছরের জানুয়ারিতে থাইল্যান্ড সফর করেন যান-যন্ত্রপাতি পরিচালনার ওপর জ্ঞান আহরণ করতে। প্রধান আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিউল আরিফ গত বছরের ৭-১৩ জানুয়ারি যান-যন্ত্রপাতির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে তুরস্ক সফর করেন। ডিএসসিসি মেয়রের ব্যক্তিগত সচিব কবীর মাহমুদ গত বছরের ১৭-২৩ জানুয়ারি যান-যন্ত্রপাতি পরিচালনায় দক্ষতা অর্জনের জন্য অস্ট্রিয়া সফর করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/102655/