বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে গোটা দেশবাসীর একই ভাববন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জরুরি। এজন্য সমাজে কিংবা সংসারে এমনকি যেকোনো কায়কারবারে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রয়োজন।
বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত অর্জন বা বিজয় বিবেচনার জন্য বিগত ৫৩ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার প্রত্যয় এবং এর স্বরূপ পর্যালোচনার প্রসঙ্গটি এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাবনায় এসেই যায়। এক্ষেত্রে প্রথমেই গণতান্ত্রিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগের পেছনে যে অনুপ্রেরণা রয়েছে তা নিয়ে বলতে হয়। উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশীদারত্ব হিসেবে শ্রমের মূল্যায়ন সরাসরি স্বীকৃত না হলেও এটি অনিস্বীকার্য যে কোনো উৎপাদন ও উন্নয়ন উদ্যোগে ভূমি, শ্রম ও পুঁজি ছাড়াও মালিক-শ্রমিক সব পক্ষের সমন্বিত ও পরিশীলিত প্রচেষ্টাই সব সাফল্যের চাবিকাঠি। আর বর্তমানে আধুনিক শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ বিবেচনা ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে করপোরেট কালচার। মূলত মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়াসকে সমাজবিজ্ঞানীরা করপোরেট কালচারের প্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটাকে শিল্পোন্নত বিশ্বে স্থান-কাল-পাত্রভেদে উন্নয়ন ও উৎপাদনে সবাইকে একাত্মবোধের মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার প্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে গোটা দেশবাসীর একই ভাববন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জরুরি। এজন্য সমাজে কিংবা সংসারে এমনকি যেকোনো কায়কারবারে সবার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ, কর্তব্য পালনে দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পোষণ, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার ঐকান্তিক প্রয়াস প্রয়োজন। সমর্পিতচিত্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস যেমন জরুরি মনে করা হয়, তেমনি জাতীয় উন্নয়নের প্রচেষ্টায়ও সমন্বিত উদ্যোগ আবশ্যক। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে থাকা চাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবদান। অপচয়-অপব্যয় রোধ, লাগসই প্রযুক্তি ও কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য সবার মধ্যে আগ্রহ ও একাগ্রতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠা দরকার। নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নিষ্ঠা অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন ত্যাগ স্বীকারের। দায়দায়িত্ব পালন ছাড়া স্বাধীনতার সুফল ভোগের দাবিদার হওয়া বাতুলতা মাত্র। ‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ কথাটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ উৎপাদনে সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেই ফসলের ন্যায্য অধিকারপ্রত্যাশী হওয়া, তা পাচার-লুণ্ঠন সংগত কর্ম ও ধর্ম নয়। কোনো কিছু অর্জনে বর্জন বা ত্যাগ স্বীকার যেমন জরুরি, তেমনি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে বাস্তবতা জানান দেয় যে ‘বিনা দুঃখে সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’ তাছাড়া অপচয়-অপব্যয়, তহবিল তছরূপ যেকোনো সবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকেও দ্বিধান্বিত ও বাধাগ্রস্ত করে। এসব রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অর্থ-সম্পদের অপচয় না করে সংযমী হতে হবে। বিয়ের উৎসবে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নানা অনুষ্ঠানের নামে যেমন অনেক সময় অর্থ অপচয় করা হয়, তেমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা দরকার। দিনের বেলায় সড়কবাতি জ্বালানো, ট্যাপের মুখ খোলা রেখে পানি অপচয়ের মতো সামান্য অপচয়ও বিদ্যুৎ আর পানি উৎপাদন ব্যয়ের পরিমাণের আলোকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আবার উপযুক্তভাবে সন্তানকে সমাজে সুশীল ও দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে প্রেরণের নৈতিক দায়িত্বের কথা কোনো অভিভাবক উপেক্ষা করতে পারে না। অফিস, ব্যবসা, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যতটা সময় দেয়া দরকার তা দিয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তদারকিসহ তাদের মানসিক বিকাশবান্ধব কর্মকাণ্ড দেখভাল করা বিশেষ বিবেচনায় আনা জরুরি। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হওয়ার মধ্যেই সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ নিহিত। আগেই বলা হয়েছে মানুষই তার পরিবেশের নিয়ন্ত্রতা। তাকে সজ্ঞান সচেতনতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনের। সংসার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে তার নিজের অংশগ্রহণ অর্থবহ করতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার দরকার। সংসারে নানা বাদপ্রতিবাদে মানুষ বেড়ে ওঠে, তার দায়দায়িত্ব তদনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তা যথাযথভাবে পালনে সংসারের গতির চাকা সচল থাকে নির্দিষ্ট নিয়মে।
বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার কিংবা উন্নয়নকামী যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবায়নযোগ্যতা ও বাস্তবায়নের দৃঢ়চিত্ততার বিষয় বিবেচনা অগ্রগণ্য না হলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আন্তরিক প্রয়াস নিশ্চিত হয় না। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারী, প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আর সমস্যারা পরস্পরের মিত্র, একটার সঙ্গে একটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইন-শৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয়-উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। স্বৈরাচারী অলিগার্ক দুরভিসন্ধি, সম্পদ তছরুপ, তস্করের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয়-উপার্জনের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতার সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা-কর্ম-কুশলতা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মক্ষতা, কর্মকুশলতা ও সক্ষমতাজাত লাগসই প্রযুক্তি টেকসই উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য যেখানে সীমিত সম্পদ ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটা উপেক্ষা করা মানে যুগপৎভাবে অন্যান্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেয়া। তাই সমস্যার উৎসে গিয়ে তা সমাধানে ব্রতী হতে হবে।
এসব কাজ কারো একার নয়, এগুলো সবাই মিলে করতে হবে। সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টি, আস্থা আনয়ন ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া, দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুৎসুদ্ধি মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। এ ভূখণ্ডে নিকট ও দূর অতীতে যতগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো সেভাবে সফল হয়নি। এর পেছনে বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতা, গৃহবিবাদ, অনৈক্য ও সর্বোপরি নিজেরাই নিজেদের শত্রু সাজাটাই ছিল প্রধান কারণ।
কোম্পানি ব্যবস্থাপনার অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে অনাবশ্যক ব্যয় পরিহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এতে পুঁজি-ভূমি-শ্রমের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে মুনাফা অর্জন হয়। জাপানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক কোম্পানিগত প্রাণ। সেখানে শ্রমিক যাতে তার সর্বাধিক মনোযোগ কোম্পানির জন্য দিতে পারেন সেজন্য স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব বহনের ভার। কোম্পানির কাজে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে স্বামী। সংসার চালানোর বিষয় নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফোন যাবে না, বাসা থেকে কোনো ফোন আসবে না কোম্পানিতে। জাপানে নারীদের চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন, রাজনীতিতে বড় একটা দেখা যায় না। তার কারণ সমাজ তাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে পুরুষদের উৎপাদনকর্মে পূর্ণ মনোনিবেশে সহায়তা করার দায়িত্ব দিয়েছে। স্বামীর বেতনের টাকা মাস শেষে পারিবারিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। স্ত্রী ওই হিসাব অপারেট করেন। সংসারের যাবতীয় খরচাপাতি স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। স্বামী প্রতি সপ্তাহের শুরুর দিনে তার সাপ্তাহিক হাতখরচ বাবদ টাকা পেয়ে থাকেন। সেই টাকা দিয়ে পুরো সপ্তাহ তার চলতে হয়। সুতরাং স্বামীর পক্ষে অপব্যয় কিংবা বাড়তি খরচ করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই। পারিবারিক সঞ্চয় এভাবে প্রথাগত ব্যবস্থাদির দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে। জাপানের নারীরা বাইরের কাজে তেমন অবদান রাখছেন না ঠিকই, কিন্তু গৃহে যে দায়িত্ব তারা পালন করেন তার আর্থিক ও তাৎপর্য মূল্য অনেক বেশি। লাগসই ভাবনা আর টেকসই উন্নতির জন্য এটি একটি ধ্রুপদি প্রয়াস। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নেও এমন প্রয়াস আবশ্যক যেখানে নাগরিক দেশের অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে হবে মিতব্যয়ী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের চুয়ান্নতম বার্ষিকীতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, দেশ ও সমাজ উন্নয়ন ভাবনা অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন ও জবাবদিহির অনুভূতি সর্বত্র যথা বিবেচনার আলোকে আলোকিত হোক—এ প্রত্যাশা।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান