২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৯:২৯

রক্তাক্ত বিদ্রোহ : ইতিহাসের ক্ষত, প্রলম্বিত বিচার

পিলখানা ট্রাজেডির ৮ম বার্ষিকী আজ শনিবার। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দু’শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী আধা সামরিক বাহিনী সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সদর দফতর রাজধানীর পিলখানায় তথাকথিত কতিপয় দাবি-দাওয়া আদায়ের অজুহাতে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা পৈশাচিক ও বর্বর, হিং¯্র আর নারকীয় কায়দায় ওই দু’দিনে ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বিদ্রোহী বিডিআর সশস্ত্র সদস্যদের হাতে বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও নিহত হন। বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ডিজির স্ত্রী, বাসার কাজের মেয়ে এমনকি বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও।

গোটা পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তা-ব চালিয়েছিল, তা সভ্য পৃথিবীর কোনো শৃঙ্খলিত বাহিনীর ইতিহাসে এমনটি ঘটেনি। পরিকল্পিতভাবে রক্তাক্ত বিদ্রোহ সৃষ্টির মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনীটি হারায় তার ইতিহাস, পাল্টে যায় চিরাচরিত নাম। তার সাথে হারায় দীর্ঘদিনের সুনামও। সেই বিদ্রোহের অজুহাতে বিডিআর পরিণত হয় বিজিবিতে। দিনটিকে বিভিন্ন মহল থেকে সেনা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান চলে আসছে বিগত বছরগুলো জুড়েই। তার কোন ফায়সালা হয়নি আজও। দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিজিবি ও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।

বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা সিপাহী সেলিম রেজা, কাজল আলী, আবদুল বাছেত, শামীম আল মামুন জুয়েল ও ল্যান্স নায়েক ইকরামসহ ঘাতকদের হিং¯্র তা-বে সেনা পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজার হাজার সাধারণ বিডিআর সদস্যের পরিবার। বিদ্রোহীদের বিচার, সংশ্লিষ্টদের সাহায্য-সহযোগিতার পরও স্বজনহারাদের কান্না থামেনি আজও। পিলখানার ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহ ইতিহাসের ক্ষত হয়ে আছে। ওই কান্ডের প্রলম্বিত বিচারে স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছেই বছরের পর বছর। রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বদল করা হয় তাদের পোশাক।

চলতি বছরের মধ্যে পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এই মামলায় আসামী সংখ্যা অনেক। সে কারণে তাড়াহুড়া করে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। এই মামলায় আসামীপক্ষের আইনজীবীরা কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন, একই ধরনের সাক্ষ্যতে কিছু আসামীকে মৃত্যুদণ্ড ও কিছু আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করেছেন। শুনানিতে এ সংক্রান্ত আইনি জটিলতা নিরসনের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।’

এদিকে, গত বৃহস্পতিবারই ওই হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামীর ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামীদের আপিলের ওপর শুনানি আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করে হাইকোর্ট। এর আগে ২০১৫ সালে পিলখানা হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়।

জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারোয়ার কাজল বলেন, “আদালত উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করতে বলেছিলেন। আসামীপক্ষের যুক্তিতর্কও প্রায় শেষ। ল’ পয়েন্টে যুক্তিতর্ক কিছু বাকি আছে, সেগুলো শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষে ল’ পয়েন্টে পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করবেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। কিন্তু আগামী মাসে স্যারকে আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মামলার প্রস্তুতি নিতে হবে। তাছাড়া ল’ পয়েন্টে যুক্তি উপস্থাপনে প্রস্তুতির জন্যও সময় প্রয়োজন। এ দু’টি বিষয় উল্লেখ করে আদালতে আবেদন করলে ২ এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়েছে।”

এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কাজল জানিয়েছিলেন, ৩৫৬ কার্যদিবস ধরে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। ডেথ রেফারেন্স ও আসামীদের আপিল নিয়ে ৩৫ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক পাঠ করা হয়েছে ১২৪ কার্যদিবস। বাকি ২৩২ কার্যদিবস রাষ্ট্র ও আসামীপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করেছে। বৃহস্পতিবার ৩৫৯তম দিনে এসে চূড়ান্ত শুনানির তারিখ পেছানো হলো দেশের ইতিহাসে আসামীর সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলার।

পিলখানায় ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর ১৫২ জন বিডিআর সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৬৯ জন আসামীর সাজা চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দায়ের করেন রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত ৪১০ জন আসামীর সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন তাদের আইনজীবীরা। দ্রুত আপিল শুনানি করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছে। এজন্য মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত ২ কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।

বিডিআর হত্যা মামলায় মোট সাজাপ্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা ৫৭৫ জন। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে কারাগারে থাকা ১৩৮ জনের পক্ষে ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই দায়ের করা হয়েছে। অন্যদিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১২৮ জন এবং বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্ত ১৭৫ জনের পক্ষে ফৌজদারি আপিল দায়ের করা হয়। ফৌজদারি আপিল দায়ের করা হয় ২৩ জনের পক্ষে। এছাড়া পলাতক এবং মৃত আসামী বাদে বাকি ৮৪ জনের পক্ষে বিভিন্ন আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল দায়ের করা হয়।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা করা হয়। পরবর্তীকালে মামলা দু’টি স্থানান্তর হয় নিউমার্কেট থানায়। হত্যা মামলায় মোট আসামী ছিল ৮৫০ জন। ২০১৩ সালের ৫ নবেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান এই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।

আইনজীবীরা জানান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামীর ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষ হওয়ার পর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬০ আসামীর আপিল শুনানি শেষ হয়েছে। এরপর শেষ হয়েছে বিচারিক আদালতে ৬৯ আসামীর খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা আপিলের শুনানি। রাষ্ট্রপক্ষ এই ৬৯ আসামীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করে।

আসামী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামী পক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে। আদালত আসামীপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক লিখিতভাবে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যার অভিযোগে এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা করা হয়। সিআইডি কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ মামলাটি তদন্ত করেন। দুইশ’ কর্মকর্তার সহযোগিতায় দীর্ঘ ৫০০ দিন তদন্ত করেন তিনি। তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক আইনে দু’টি চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়। চার্জশিটভুক্ত আসামী রয়েছে ৮৫০ জন। এর মধ্যে বিডিআর’র পোশাকধারী ৭৮৫, বিডিআর’র সিভিল ৪২, বেসামরিক ২২ ও আনসার একজন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৩ সালর ১৩ নবেম্বর ১৫২ জনকে ফাঁসি, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, তিন থেকে ১৪ বছর মেয়াদে ২৫৬ জনসহ মোট ৫৬৮ জনকে দণ্ড প্রদান করেন আদালত। খালাস প্রদান করা হয় ২৭৮ জনকে।

তবে এই মামলা চলাকালীন ৯ জন আসামীর মৃত্যু হয়। এর মধ্যে রায়ের আগে ২০১০ সালের ২৯ জুলাই ডিএডি আবদুর রহিম, একই বছরের ৫ আগস্ট হাবিলদার রফিকুল ইসলাম, ২০১১ সালের ১৫ মে হাবিলদার মতিউর রহমান ও ২০১৩ সালের ২৪ মে হাবিলদার ফরহাদ হোসেনের মৃত্যু হয়। রায় ঘোষণার পর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর খালাসপ্রাপ্ত নায়েক সুবেদার আবদুল মতিন মিয়া, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমান, একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সিপাহী শফিকুল ইসলাম, ৭ অক্টোবর ১০ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত নায়েক সুবেদার শহিদুল ইসলাম, ২৭ অক্টোবর ল্যান্স নায়েক খালাসপ্রাপ্ত আশরাফুল ইসলাম, গত বছেরর ৩ মার্চ খালাসপ্রাপ্ত হাবিলদার মাহতাব উদ্দিন, ৩ মে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, ১৮ আগস্ট সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর আবদুল কাইয়ূম, গত ৯ জানুয়ারি খালাসপ্রাপ্ত এনসিই শ্রী সানু চন্দ্র মারা যান।

এদিকে একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার কার্যক্রমও শেষ হয়নি। বিদ্রোহের ঘটনা তদন্ত করে ২০১০ সালের ২৭ জুলাই বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় ৫৩৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম একই আদালতে চলমান।

যা ঘটেছিল সেদিন: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন পিলখানায়। আগের দিন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মাঝে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিল। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহী মইন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সঙ্গে সঙ্গে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের দাবি-দাওয়া শুনবেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়। একপর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাথাড়ি গুলী শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তাদেরকে খুঁজে খুঁেজ বের করে জওয়ানরা হত্যা করে। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে বিডিআর জওয়ানরা। এসবই করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙে অস্ত্র এবং ম্যাগাজিনগুলো তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলীতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতংকে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তা-বে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি। বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ড মাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গির কবির নানক। মাইকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআর’র ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাত করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এরপরও তারা অস্ত্র সমর্পণ ও বন্দিদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করে। কিন্তু পরদিনও থেমে থেমে গুলীর শব্দ আসতে থাকে। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্র সমর্পণ করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ : এদিকে, ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ উদ্ধার। একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৫টি লাশ। এভাবে উদ্ধার হয় ৫৭ সেনা কর্মকর্তা ও সামরিক-বেসামরিকসহ মোট ৭৪ জনের লাশ।

এই ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে দু’টি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়। এর একটি ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। অপরটি ছিল সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে। দু’টি তদন্ত কমিটিই যথাসময়ে তাদের তদন্ত রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ হয়ে দফায় দফায় তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার দিনক্ষণ পেছাতে থাকে। একসময়ে এসে ওই কমিটি দু’টোই তাদের তদন্ত রিপোর্ট সরকারের সংশ্লিষ্টদের হাতে জমা দেন। তাতে কি ছিল তা আজও জানা না গেলেও তৎকালীন মিডিয়ায় এ নিয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে যে বক্তব্য জনসমক্ষে এসেছিল, তাতে বলা ছিল দু’টো তদন্ত কমিটিই তাদের রিপোর্টের সুপারিশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটি নিয়ে আরও অধিকতর তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেছে। কিন্তু ওই সব সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি।

বিচার কার্যক্রম: বাহিনীর নিজস্ব আইনেও পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৭টি বিদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ছয় হাজারেরও বেশি বিডিআর সদস্যকে আসামী করা হয়। নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ১২ ও ২৭ জুলাই বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টুসহ ৮২৪ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। এদের মধ্যে বিডিআরের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত বেসামরিক আসামী ছিলেন ৪০ জন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি এ দু’টি চার্জশিট আদালত আমলে নেন। ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য ছিল। ওইদিন সরকার পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে ৩ মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করেন এবং এর মধ্যে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ২১ মার্চ এই মামলায় আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এই মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন হয় বকশিবাজার আলিয়া মাদ্ররাসা মাঠের বিশেষ আদালতে। এতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আর খালাস দেয়া হয় ২৭১ জনকে। ৮৫০ জন আসামীর মধ্যে ৪ জন বিচার শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।

এদিকে, বিদ্রোহের পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। ৫৭টি মামলায় মোট আসামী ৬ হাজার ৪১ জন। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সদর ব্যাটালিয়নের বিচার কার্যের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের বিচার শেষ হয়। আসামীদের মধ্যে মোট ৫ হাজার ৯২৫ জনের শাস্তি হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ১১৫ জন জওয়ান। অব্যাহতি পেয়েছে ৫ জন। অব্যাহতিপ্রাপ্তরা বিচার চলাকালীন মারা গেছেন। মোট ১১টি আদালতে বিদ্রোহের বিচার চলে। ঢাকায় ছিল মোট ১১টি মামলা। ঢাকায় আসামী সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮৯ জন। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৪ হাজার ৩৩ জনের।

মামলাগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৪ অক্টোবর প্রথম বিচার শুরু হয় রাঙামাটির ১২ রাইফেল ব্যাটালিয়ন রাজনগরের ৯ জনের বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে ২০১০ সালের ২ মে এই মামলার প্রত্যেক আসামীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।

২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের ৭২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়ার মধ্য দিয়ে ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার নিষ্পত্তি সম্পন্ন করা হয়।

অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলাটি চলছে খুবই ধীরগতিতে। যার কারণে বিচারপ্রার্থী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। অনেক আসামীই বছরের পর বছর কারাগারে আটক থেকে মারা যাচ্ছেন। যাদের অনেকেই হয়তো মামলায় খালাস পেয়ে যেতেন। এতে আসামীরা ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনই অভিযোগ মামলা দু’টির আসামী পক্ষের আইনজীবীদের।

http://www.dailysangram.com/post/273205