২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ২:১২

জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে

গ্যাস ঘাটতির সমাধান হয়নি। বাসাবাড়ি, কলকারখানা কোথাও চাহিদা মতো গ্যাস মিলছে না। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিএনপি এই বর্ধিত দাম অযৌক্তিক বলে প্রত্যাহারের দাবি করেছে। সাধারণ ভোক্তারা বলছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি দৈনন্দিন ব্যয়ে বড় প্রভাব ফেলবে।

অনেকেই মাসের খরচ কাটছাঁট করতে বাধ্য হবেন। শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না। কারখানা চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর ফলে তাদের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, পরিবহন ভাড়া বাড়বে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবন ধারণের ব্যয় বেড়ে যাবে। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গতকাল ফেসবুকেও অনেকে দাম বাড়ানোর তীব্র সমালোচনা করেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, পেট্রোবাংলা ও এর অধীন কোম্পানিগুলো প্রায় প্রতিটিই লাভজনক। তাদের তহবিলে ২৫ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণাকে তারা অযৌক্তিক দাবি করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনেকের মতে, এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা থাকত। কিন্তু এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে গ্যাসচালিত শিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়বে। বাড়বে পরিবহন ভাড়া। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। অর্থনীতি চাপে পড়বে।

মাসিক খরচে কাটছাঁট করতে হবে : গ্যাসের দাম বাড়ানোয় বেশি অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে। রামপুরা বনশ্রীর বাসিন্দা লীনা পারভীন সমকালকে বলেন, 'আমি অবশ্যই চাইব নিত্যব্যবহার্য পণ্য সহজলভ্য হবে। কারণ এমনিতেই আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করে চলতে হয়। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাসিক খরচ করতে হয়। এভাবে প্রতি বছর গ্যাসের দাম বাড়ানো মেনে নেওয়া যায় না।'

শিল্প সক্ষমতা হারাবে : শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। রফতানি পণ্যের দাম বাড়েনি। কারণ, বিদেশি ক্রেতারা বেশি দাম দিচ্ছে না। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আরেক দফা দাম বাড়ানোর ফলে অনেক শিল্পকারখানাই বন্ধ হয়ে যাবে।

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি তপন চৌধুরী সমকালকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বস্ত্র খাত। বড় আকারের স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও প্রিন্টিং-ফিনিশিং কারখানাগুলোর একমাত্র জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস। ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাসের ইউনিট প্রতি দর ছিল ৪ দশমিক ১৮ টাকা, একই বছর সেপ্টেম্বরে দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হয় ৮ দশমিক ৩৬ টাকা। এখন আবার নতুন করে দর বাড়ানোর কারণে বড় ধরনের চাপে পড়বে বস্ত্র খাত। ফলে ভারত এবং চীনের কাছে বাজার হারাবে তৈরি পোশাকের পশ্চাদসংযোগ শিল্পটি। কয়েক মাস আগে ভারত নতুন বস্ত্রনীতিতে সাড়ে ছয় হাজার কোটি রুপির প্রণোদনা অনুমোদন করেছে। আগামী তিন বছরে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশকে টপকে যেতে বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে ভারত। তুলা, সুতাসহ সব ধরনের কাঁচামাল এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি ভারতের নিজস্ব। এ কারণে এ ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে এবার আর টিকতে পারবে না আমাদের বস্ত্র খাত। একই কথা জানিয়ে বিটিএমএ সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, বারবার দাম বাড়ার কারণে ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রফতানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সংকটে পড়বে।

তৈরি পোশাকের নিট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান সমকালকে বলেন, আগে থেকে না জানিয়ে দর বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিট খাত। গ্যাস ছাড়া বিকল্প কোনো কিছু দিয়ে নিট কারখানা চালানো যায় না। দর বাড়ানোর আগে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন ছিল। এ নিয়ে সংসদেও আলোচনা করা যেত। কোথাও আলোচনা হয়নি।

বাংলাদেশ পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের দাম কমাচ্ছে। রফতানি কমছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। ফলে শিল্প মালিকরা সক্ষমতা হারাবেন। কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।

পরিবহন ভাড়া বাড়বে : সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, মাত্র ১৫ মাস আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন সিএনজির যে দাম রয়েছে তা এ খাতের জন্য সর্বোচ্চ। তাই দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারপরও দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়বে। ফলে প্রকৃতপক্ষে সাধারণ জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার দাম বাড়িয়ে পরোক্ষভাবে সিএনজি ব্যবহার বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

মামলার হুমকি : ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, যেখানে বাসাবাড়িতে গ্যাসই থাকে না, সেখানে গ্রাহকরা বাড়তি অর্থ গুনতে যাবে কেন? তিনি দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে তারা আদালতে যাবেন। 

http://bangla.samakal.net/2017/02/24/272519