২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ১২:২৬

কাদেরের বাড়ি থেকে অবৈধ পিস্তল উদ্ধার

১ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের ফোন রেকর্ডেই ঘাতক চিহ্নিত * কিলারদের বাসের টিকিট সরবরাহকারী রানা গ্রেফতার

‘এই মুহূর্তে বাইরের কেউ নেই। দু’জন ছিল, তারা চলে গেছে। তুমি কি একাই আছো। জি বস, আমি একাই বসে আছি।’ ৩১ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা ১২ মিনিটে একটি ফোনের কথোপকথনে জট খুলে দেয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের। ওই ফোনে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের সঙ্গে কথা বলছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিক পরিচয়দানকারী চন্দন কুমার গোস্বামী। তার (চন্দন কুমার গোস্বামী) ১ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের এই কথোপকথনই সংসদ সদস্য লিটন খুনের ‘ক্লু’ উদঘাটনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তবে কথা বলার সময় সাবেক সংসদ সদস্য কাদের খান তার নিজের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি। তিনি (কাদের খান) তার গাড়িচালক হান্নানের মোবাইল ফোন থেকে চন্দন কুমার গোস্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন।

এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হান্নানের ওই মোবাইল থেকে আরও একটি কল করেন কাদের খান। এ সময় তিনি কোনো একজনকে বলেন, ‘সবকিছুই ঠিকঠাক আছে, তোমরা মুভ করো।’ ওই ফোন কলের মাত্র ১৭ থেকে ১৮ মিনিটের মধ্যেই সুন্দরগঞ্জের সাহাবাজে নিজ বাসায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন।

এদিকে বুধবার রাত ১টার দিকে কাদের খানের গ্রামের বাড়ির আঙিনায় একটি গাছের পাশে মাটি খুঁড়ে একটি পিস্তল ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১০ দিনের রিমান্ডে থাকা কাদের খান প্রথম দিনেই সংসদ সদস্য লিটন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রের ব্যাপারে মুখ খোলেন। আর তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী কাদের খানকে নিয়ে পুলিশের একটি দল বুধবার বিকালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছাপড়হাটিতে তার গ্রামের বাড়িতে (খান বাড়ি) অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ২০ সদস্যের একটি দল বাড়ি সংলগ্ন ৩টি পুকুরের পানি সেচে ফেললেও কোনো অস্ত্র পায়নি। পরে বাড়ির আঙিনায় একটি আমগাছের পাশ থেকে পুলিশ মাটি খুঁড়ে ওই অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে। পুলিশের ধারণা, উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি সংসদ সদস্য লিটন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে। এদিন রাতে রাজধানী ঢাকা থেকে ঘাতকদের সহায়তার অভিযোগে আনোয়ারুল ইসলাম রানা নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, গ্রেফতারকৃত আনোয়ারুল ইসলাম রানা বাসের টিকিট কেটে কিলারদের বগুড়া থেকে ঢাকায় পাঠানোয় সহায়তা করেছিল। ঢাকায় একটি গার্মেন্টে কর্মরত আনোয়ারুল ইসলাম রানার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ওই টিকিট উদ্ধার করেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) আবু হায়দার মো. আশরাফুজ্জামান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রানা এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাকে বৃহস্পতিবার বিকালে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের জন্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়।

গাইবান্ধা থেকে নাজমুল হুদা নাসিম ও গোবিন্দ লাল দাস জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম তার কার্যালয়ে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে সংসদ সদস্য লিটন হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় সুন্দরগঞ্জের ভেলারা কাজীর ভিটা গ্রামের মৃত তমশের আলীর ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম রানাকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানান। রানা ঢাকায় একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। একই সঙ্গে ঘাতকদের যে পরিবহনে বগুড়া থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল সে টিকিটের একটি কপিও উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন আরও কয়েকজনকে খোঁজা হচ্ছে জানিয়ে এসপি বলেন, এর মধ্যে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ গ্রামের সুশীল সরকারের ছেলে চন্দন সরকার অন্যতম।

চন্দন সরকারের খোঁজে পুলিশ : সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহদফতর সম্পাদক চন্দন সরকারকে পুলিশ খুঁজছে। কাদের খানের জব্দ করা মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তার সঙ্গে চন্দন সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের দিন এমপি লিটনের অবস্থান এবং অনুকূল পরিবেশের খবর মোবাইল ফোনে ঘাতকদের জানান চন্দন। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী, কিলিং মিশন সফল করে খুনিরা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান চন্দন সরকার উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার পর থেকেই চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ফলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি লিটন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এ ক্ষোভে তিনি সুন্দরগঞ্জে এমপি লিটনবিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এমপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ছাড়া সভা-সমাবেশে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। কাদের খান গ্রেফতারের পর থেকেই চন্দন গা ঢাকা দেন।

কাদের খানের অবৈধ অস্ত্রের খোঁজে পুলিশ : অবৈধ অস্ত্রের সন্ধান করতে ব্যাপক তল্লাশি ও কাদের খানকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে তার লাইসেন্স করা একটি পিস্তল এবং ১০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া বুধবার গভীর রাতে তার গ্রামের বাড়ি থেকে লাইসেন্সবিহীন ৬ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কাদের খানের কাছে আরও লাইসেন্সবিহীন পিস্তল এবং গুলি থাকতে পারে। রিমান্ডে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে পুলিশ আশাবাদী।

কে এই কাদের খান : সুন্দরগঞ্জের উপজেলার বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কাদের খানের আদি বাসস্থান ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তার দাদা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি গ্রামে জমি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। কাদের খানের বাবার নাম হাসেন আলী খাঁ। তার (কাদের) স্ত্রী ডা. নাসিমা বেগম একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি চাকরি করছেন। ২০০৪ সালে কর্নেল পদ থেকে অবসর নেন কাদের। এরপর তিনি বগুড়া শহরের রহমাননগরের জেলাদারপাড়ায় গরিব শাহ্ নামে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে স্ত্রীসহ তিনি রোগী দেখতেন। ওই ক্লিনিকের চতুর্থ তলায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। এর পাশাপাশি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটি গ্রামের বাড়িতেও একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে সেখানে তিনি মাঝে মধ্যে থাকতেন।

রিমান্ডের প্রথম দিন : এমপি লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জাপার সাবেক এমপি আবদুল কাদের খানের ১০ দিনের রিমান্ডের প্রথমদিন বুধবার জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তকারী কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) আশরাফুজ্জামান জানান, আবদুল কাদের খানের তথ্যমতে, পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। আরও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার শাহবাগে গ্রামের বাড়িতে খুন হন সংসদ সদস্য লিটন। স্থানীয় থানা পুলিশ তদন্ত করলেও প্রথম থেকেই পুলিশ সদর দফতর পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছে।

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার পরদিনই সুন্দরগঞ্জের শাহবাগে এমপি লিটন খুন হওয়ার আগে-পরে কারা ওই বাসায় এসেছিলেন, তা জানতে পুলিশ সদর দফতরে স্থাপিত অত্যাধুনিক ট্রাকার সেন্টার অনুসন্ধান শুরু হয়। ৩১ ডিসেম্বর ঘটনার অন্তত তিন দিন আগে ও পরে ওই এলাকায় ব্যবহৃত প্রায় ১০ হাজার মোবাইল ফোনের ভয়েস রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়। এসব ভয়েস রেকর্ডের মধ্যেই ছিল সন্দেহভাজন এই কথোপকথন। এর মধ্যে একটি ফোনের মালিক চন্দনের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও অপর প্রান্ত সাবেক সংসদ কাদের খানের কণ্ঠের বিষয়ে নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় নেয় পুলিশ।

এ ছাড়া ঘটনার আগের দিন (৩০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ধোপাপাড়া নামক স্থানে পিস্তলের ছয় রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগাজিন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধারের পর তা পরীক্ষার মাধ্যমে এমপি লিটন খুনের নেপথ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। সেদিন ওই সড়কে মেহেদি নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময় ছিনতাইকারীদের ব্যবহৃত পিস্তলের গুলিভর্তি ওই ম্যাগাজিনটি সেখানে পড়ে যায়।

তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, উদ্ধার করা ম্যাগাজিনে যে গুলি ছিল, তা সাবেক সংসদ সদস্য কাদের খান তার লাইসেন্স করা পিস্তলের জন্য উত্তোলন করেছিলেন। এ ছাড়া ময়নাতদন্তকালে নিহত সংসদ সদস্য লিটনের দেহ থেকে যে গুলি উদ্ধার করা হয়, সেটিও ছিল একই সিরিয়ালের। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই পুলিশ সদর দফতর থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তা জানানো হয়। আর ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে পুলিশ গত মঙ্গলবার বিকালে বগুড়া শহরের রহমাননগর জিলাদারপাড়ার ক্লিনিকসংলগ্ন বাসভবন থেকে সাবেক সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে। এর প্রায় সপ্তাহখানেক আগে থেকে নজরবন্দি করা হয় সাবেক সংসদ সদস্যকে। সাদা পোশাকের পুলিশ সার্বক্ষণিক তার (কাদের খান) গতিবিধি নজরদারি করতে থাকে।

এদিকে গত সপ্তাহে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে সংসদ সদস্য লিটনের শরীর থেকে উদ্ধার হওয়া গুলির ব্যালাস্টিক রিপোর্ট হাতে পায় পুলিশ সদর দফতর। এর আগেই গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ধোপাপাড়া থেকে পরিত্যক্ত ম্যাগাজিন ভর্তি গুলির মালিকানার বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়। পুলিশ জানতে পারে, গত বছরের মাঝামাঝি সাবেক সংসদ সদস্য কাদের খান তার লাইসেন্স করা পিস্তলের জন্য ৫০ রাউন্ড গুলি উত্তোলন করেন। তবে সংসদ সদস্য লিটনের মৃত্যুর পর গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনের সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৈধ অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ওই সময় কাদের খান তার নামে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি শটগান লোক মারফত থানায় জমা দেন। এর মধ্যে পিস্তলের ম্যাগাজিন খোয়া গেছে বলে জানান। পুলিশ জানতে পারে, তার নামে ৫০টি গুলি ইস্যু করা থাকলেও ৪০ রাউন্ড গুলির কোনো তথ্য তিনি দিতে পারেননি। পুলিশ এ সময় ছিনতাইকারীদের ফেলে যাওয়া ম্যাগাজিনের গুলির সঙ্গে তার জমাকৃত পিস্তলের গুলি মেলানোর পর বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

রানার গ্রেফতারের আগে সংসদ সদস্য লিটন খুনের ঘটনায় তিন ঘাতককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারদের মধ্যে কাদের খানের গাড়িচালক হান্নানসহ কিলিং মিশনে অংশ নেয়া মেহেদী হাসান ও শাহিন মিয়াকে আটক করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার এই তিনজনই ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মঙ্গলবার ওই তিনজন গাইবান্ধায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থ জোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/24/103631