২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ১২:১৭

এমপি লিটন হত্যার সমন্বয়কারী চন্দন কুমার এখন ভারতে

সুন্দরগঞ্জ আসনের সরকারদলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন চন্দন কুমার সরকার। দীর্ঘদিনের অপমানের জমানো ক্ষোভের বশীভূত হয়ে মনে-মনে এমপি লিটনকে হত্যার স্বপ্ন দেখছিল উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের পূর্ব মনমথ গ্রামের সুশিল কুমার সরকারের ছেলে চন্দন কুমার সরকার। এরই একপর্যায় স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করে জাপার সাবেক এমপি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডাঃ আব্দুল কাদের খান। দুইজন মিলে পরিকল্পনা করতে থাকেন এমপি লিটন হত্যার। অবশেষে তা বাস্তবায়ন করেন গেল বছরের ৩১ ডিসেম্বর।

কে এই চন্দন সরকার? বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন আ’লীগের দপ্তর সম্পাদক- চন্দন কুমার সরকার। রাজনীতিতে আসার আগে ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। দুই বছর সাংবাদিকতা করে বাড়িতে ফিরে এসে রাজনীতিতে যোগদেন চন্দন। অল্প সময়ে এমপি লিটনের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। চলাফেরার একপর্যায়ে চরমভাবে চন্দনকে লাঞ্ছিত করে এমপি লিটন। শুরু হয় ক্ষোভ। এরপর থেকে এমপি লিটনের যাবর্তীয় কর্মকা-ের চিত্র তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করতে থাকেন চন্দন। বেশ কয়েকটি অভিযোগ ইতিমধ্যে তদন্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত অর্থ বছরে এমপির বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকার দুর্নীতি অভিযোগ করেন দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গেল বছরের নভেম্বর মাসে উপজেলা বঙ্গবন্ধু চত্বরে দুবৃর্ত্তদের হাতে গুরুত্বর আহত হন চন্দন। এনিয়ে এমপি লিটনকে আসামী করে থানা মামলা করতে যান চন্দন। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। চন্দন কুমার সরকারকে থামানোর জন্য জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে একটি মামলার আসামী দেখিয়ে চন্দনকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠিয়ে দেন এমপি লিটন। পরবর্তীতে মামলাটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এসব পুঞ্জীভূত অপমানের প্রতিশোধ নিতে লিটন হত্যার পরিকল্পনায় আব্দুল কাদের খানের সাথে এক হয়ে যায় চন্দন। লিটন হত্যার পর চন্দন কুমার ভারতে চলে যায়। নাম প্রকাশ না করা শর্তে মনমথ গ্রামের একজন এলাকাবাসী জানান-লিটন হত্যার পরদিন চন্দন ভারতে চলে যায়। বাড়ির লোকজন এবং প্রতিবেশীদের নিকট থেকে বিষয়টি জেনেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন-চন্দন রাতে একজন লোককে মোবাইল-ফোনে বলছিল আমাকে অপমান করার সাধ মিটে গেছে। বৃহস্পতিবার চন্দনের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে পরিবারের কোন সদস্য নেই। বাড়ি-ঘরে তালা ঝুলছে।

শুধু ক্ষমতার লোভ নয়, ক্ষোভ ছিল কাদেরের: শুধু ক্ষমতার লোভে নয়, এমপি লিটনের প্রতি ক্ষোভও ছিল আব্দুল কাদের খানের। মহাজোটের সরিক দল হিসেবে ২০০৮ সালে লিটনকে ডিঙ্গিয়ে আব্দুল কাদের খান মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এমপি হওয়ার পর থেকে আব্দুল কাদের খানের যাবতীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে দুর্র্নীতির অভিযোগ এনে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন এমপি লিটন। এ কারণে আব্দুল কাদের খানকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হয়েছিল। এসব ঘটনাও রয়েছে এমপি লিটন হত্যার কারণ। সব মিলে চন্দনের অপমানের প্রতিশোধ এবং আব্দুল কাদের খানের ক্ষমতার লোভে খুন হয়েছেন এমপি লিটন। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে-খুনের পরিকল্পনার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন চন্দন কুমার। দীর্ঘদিন থেকে চন্দন কুমার আব্দুল কাদের খানের সাথে যোগযোগ রক্ষা করে পরিকল্পনা মাফিক খুন করে এমপি লিটনকে।

হত্যাকা-ের ব্যবহৃত পিস্তল উদ্ধার: বুধবার দিনব্যাপী আব্দুল কাদের খানের গ্রামের বাড়ি উপজেলার ছাপড়হাটী ইউনিয়নের খানপাড়ায় তিনটি পুকুর, ঘর-বাড়ি, উঠান-আঙ্গিনায় তল্লাশি করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ডুবুরি ইউনিট। কিন্তু কোথাও অস্ত্রের সন্ধান না পাওয়ায় ওই দিন রাত দেড়টার সময় পুলিশ আব্দুল কাদের খানকে গাইবান্ধা থেকে তার বাড়ি নিয়ে আসে। তার দেয়া তথ্য মতে শয়ন ঘরের চার হাত দূরে আঙ্গিনার মাটির নিচ থেকে একটি চায়না পিস্তল, ছয় রাউ- গুলীসহ একটি ম্যাগজিন ও একটি ফাঁকা ম্যাগজিন উদ্ধার করে পুলিশ। থানার ওসি আতিয়ার রহমান জানান-উদ্ধারকৃত পিস্তল ও গুলী জব্দ করা হয়েছে এবং তা গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের কার্যালয় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আব্দুল কাদের খানের বাড়িতে পুলিশ টহল অব্যাহত রয়েছে।

রিমা-ের প্রথম দিন : এমপি লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জাপার সাবেক এমপি আব্দুল কাদের খানের ১০ দিনের রিমা-ের প্রথম দিন জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শন আশরাফুজ্জামান জানান- আব্দুল কাদের খানের তথ্য মতে পিস্তল ও গুলী উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত পলাতক রানা মিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সাধারণ মানুষের অভিমত: এমপি লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক জাপার এমপি আব্দুল কাদের খান গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখে দিয়েছে। সাধারণ মানুষজনের দাবি পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে যাদেরকে গ্রেফতার করেছেন-তাদের ব্যাপারে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা উচিত। তা না হলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলবে অনেকে।

আরেক আসামী রানা গ্রেফতার : সুন্দরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার আরেক আসামী আনারুল ইসলাম রানাকে (২৮) ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, যিনি লিটনকে হত্যার সময় অংশ নিয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রানার বাড়ি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভেলারায় কাজীর ভিটা গ্রামে।

গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম রানাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে গ্রেফতার রানাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেওয়ার জন্য আদালতে নেওয়া হবে।’

বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানান, লিটন হত্যাকা-ে হান্নান, মেহেদী, শাহীন ও রানা অংশ নেয়। তাদের মধ্যে গত মঙ্গলবার ভোরে গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে হান্নান, মেহদী ও শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এরপর তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পলাতক রানাকে ঢাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গার নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের গুলীতে আহত হন এমপি লিটন। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

খুনিদের গ্রেফতার করতে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে শাহীন, মেহেদি, হান্নানকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তারা হত্যাকা-ে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দেন।

আদালতকে তিনজন জানান, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল কাদের খানের পরিকল্পনায় তারা এমপি লিটনকে হত্যা করেন। এই হত্যাকা-ে রানা নামে আরও একজন অংশ নিয়েছিল। তাদের দেয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার কাদের খানকে বগুড়ার রহমাননগরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া রানাকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি।

http://www.dailysangram.com/post/273086