২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ১০:১৩

কতিপয়ের আইন

আলমগীর মহিউদ্দিন

ধারণাটি প্রচলিত বহু সহস্র বছর ধরে। তবে আধুনিককালে এর ব্যাপক প্রচার ঘটে ইটালীর এক অর্থনীতিবিদের মন্তব্য নিয়ে। ভিলফ্রেডো প্যারেটো বললেন, ‘উৎপাদন এবং জোগানের ব্যাপক পার্থক্য থাকে। মাত্র ২০ শতাংশ অপর ৮০ শতাংশের কাজ করে।’ তার এই মন্তব্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ, এটাই বাস্তবতার একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। জীবনের সর্বত্র এর প্রতিফলন দেখা যায়।

তাই এই পর্যবেক্ষণ ‘প্যারেটোর আইন (Pareto’s Law), কতিপয়ের আইন (Law of the few), বা ৮০/২০ আইন (the 80/20 rule) বলে আজ প্রচলিত। অনেকেই এই অবস্থানকে বলেন, কতিপয় খুঁতসন্ধানী বনাম বহু নগণ্য (the critical few versus trivial many)। যেভাবে বা নামেই বর্ণনা দেয়া হোক না, বিষয় একটিই।

প্যারোটো (Vilfredo Pareto) ‘জীবনবোধ থেকে গবেষণা’ মন্তব্যটি করেননি। ইটালীর অর্থনৈতিক অবস্থা অবলোকন করে মন্তব্যটি করেছিলেন, ‘মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ ইটালীর সব সম্পদের মালিক। অপর ৮০ শতাংশ তাদের ওপর নির্ভরশীল।’ তিনি উদাহরণ হিসেবে উৎপাদন ব্যবস্থা, ব্যবস্থাপনা এবং মানবসম্পদের ব্যবহার উল্লেখ করেন। কোনো জিনিসই সমানভাবে বিতরণ করা হয় না। তিনি দেখান ২০ ভাগ জোগান দিয়ে ৮০ ভাগ বিষয় উৎপাদন হয়। মাত্র ২০ ভাগ কর্মীর প্রচেষ্টা সমগ্র উৎপাদনের ৮০ ভাগের জন্য দায়ী। মাত্র ২০ ভাগ ক্রেতা ৮০ ভাগ আয় জোগায়; ২০ ভাগ ভুলের জন্য ৮০ ভাগ পতন দায়ী। ২০ ভাগ উপাদান ৮০ ভাগ ব্যবহারে আসে ইত্যাদি। সাধারণ পর্যবেক্ষণে এটাই সত্য মনে হবে।
তবে এটা জীবনের পরম সত্য নয়। সত্য হলো জীবনব্যবস্থা বা জীবন ধারণ নির্ভর করে স্বল্পসংখ্যক সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড বা উপাদানের ওপর। এটা ৮০-২০ মধ্যে নয় বা তা যোগ করেও নয়।

যেমন সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পায় গুটিকয়েক মানুষের কাছে। তারা তাদের প্রভাবিতও করে। এটাকে সবাই ‘কতিপয়ের আইন’ (The Law of the few) বলে অভিহিত করেছেন। এ তথ্যগুলোকে আইন বলার কারণ, সাধারণ জীবনব্যবস্থা অনেকাংশে এসব তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য এসব বিষয় নিয়ে বিশাল অনুসন্ধান ও আলোচনা হয়েছে। তারা ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রচার, সংবাদপত্রের খবর কেমনভাবে জনমত সৃষ্টি করে, নির্বাচন প্রভাবিত করে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন মাত্র কতিপয়ের চিন্তা-বক্তব্য-কর্মকাণ্ড সবাইকে প্রভাবিত করে।

বিভিন্ন বিষয়ের ওপরেও এমন অনুসন্ধান করে একই ফল পাওয়া গেছে। যেমন, ক্রমেই এবং অন্যরা বা ফরচুন ৫০০ প্রতিষ্ঠানের ওপর এক জরিপ চালায় ২০০১ সালে। তারা দেখতে পান ৮৫ ভাগ পরিচালক বা ম্যানেজারই ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এসব তথ্য তারা পান তাদের বন্ধু বা স্বল্পসংখ্যক তথ্যদানকারীর কাছ থেকে।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এই আইন বা পদ্ধতি আরো ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। যেমন ফেসবুক, ইন্টারনেট, অনলাইন, ই-মেইল ও ফোনকল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এক ুদ্রগোষ্ঠী বিপুল ব্যবহারকারীকে প্রভাবিত করতে পারে বলে এই জরিপে দেখা গেছে। আসলে এসব মাধ্যমের অনেক তথ্যই আসে ুদ্রসংখ্যক বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে।
ফিক এবং প্রাইস (Feick and Price) ১৯৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই কতিপয়ের আইনের ওপর এক জরিপে দেখতে পান, মাত্র কিছু ‘বিজ্ঞ’ ব্যক্তি সব তথ্যের উৎস। সবাই তারা ‘জ্ঞানী’ বলে তথ্যের জন্য তাদের কাছে যায়। তারা সেই ব্যক্তিকে ‘ম্যাভেন’ (Maven) বলে অভিহিত করল। অর্থাৎ এক বা কয়েক ব্যক্তির বক্তব্য-ইচ্ছা-নির্দেশ আইনের মতো কাজ করে। আসল কথা হলো, জীবন ধারণের জন্য যে প্রচেষ্টা, পরিতোষিক এবং উৎপাদন তা সমানভাবে বিস্তৃত নয় এবং সম্ভবও নয়। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানের এক ুদ্রাংশ (ধরা যাক, ২০ ভাগ) তার ৮০ ভাগ উৎপাদন করে। অবশিষ্ট জনশক্তি শুধু সহায়ক শক্তি হিসেবে বিরাজ করে। তবে সবাই সেই প্রতিষ্ঠানের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।

প্যারেটোর আইন অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ, এর দ্বারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে পারে তার কর্মকাণ্ডের বেশির ভাগ অংশ কাদের পরিশ্রম বা চেষ্টার ফসল। তারা তাদের ওপর সঠিক নজর দিলে পুরো জনশক্তিই তাদের উৎপাদন বা কর্মকাণ্ডকে সামগ্রিকভাবে সচল রাখতে সম্ভব হয়। চেষ্টা, সময় ও শ্রমকে তাই সঠিকভাবে নিরূপিত করে সমগ্র উৎপাদনে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।

আর একটি কারণে এই ‘কতিপয়ের আইন’ জনপ্রিয়। এটা হলো, চিন্তার জগতে। একটি ভাবনা, চিন্তা, ধারণা সমগ্র ব্যবস্থার ওপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একটি মানুষের চিন্তাই সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশাল পরিবর্তন এনেছে। যেমন বিজ্ঞানের জগতে কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন বা আইনস্টাইনের চিন্তা ও ভাবনা কী বিশাল পরিবর্তন এনেছে। তেমনি রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কতিপয়ের চিন্তা বা চেষ্টা কী বিরাট অভ্যুত্থান ঘটায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম থেকে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ও বিপ্লবের পেছনে ছিল কতিপয়ের চিন্তা। ধরা যাক মার্টিন লুথার কিংয়ের জীবন। তার ধারণা ও চিন্তাভাবনা রাজনৈতিক ধারার জগতে আনে বিপ্লব। ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের পেছনে আছে কতিপয়ের ভাবনা, যা কতিপয়ের আইনে পরিণত হয়।

শুধু কি তাই? মাত্র ক’টি শব্দ মানুষের মনকে শুধু জয়ই করে না, লাখ লাখ মানুষের মনকেও পরিচালনা করে। যেমন প্রবাদগুলো। যে কোনো জাতির এবং ভাষার প্রবাদগুলো কখনো লিখিত থাকে না; কিন্তু সেগুলো সে জাতির মনমানসিকতাকে আচ্ছন্ন ও পরিচালনা করে। বাংলা ভাষায় এমন বহু প্রবাদ আছে যা সবাই জানে এবং মনের অজান্তে তেমনিভাবে চিন্তা ও কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়।

যেকোনো মানুষের জীবনে এটি সাধারণ ঘটনা। সামান্য কিছু চেষ্টায় এমন কিছু ঘটে যা তার জীবনের বহু চেষ্টা ও পরিশ্রমের চেয়ে অনেক বড়। যেমন ধরা যাক সম্পর্কের কথা। কোনো বন্ধুর এক দুই মিনিটের টেলিফোন বাক্যালাপ সারা জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। আবার এক স্বল্পপরিচিতের সাহায্য সারা জীবনের এক আকাক্সা পূরণ করে। আবার একটি ছোট্ট ভুল সারা জীবনের ফসলকে ধূলিসাৎ করতে সক্ষম।

এই ‘কতিপয়ের আইন’ মানুষের জীবনের সর্বত্র বিচরণ করে। বিশ্বের যেকোনো দেশের একাংশে বেশির ভাগ লোক বাস করে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ ভাগ মানুষ বাস করে মাত্র ৯টি স্টেটে (যুক্তরাষ্ট্রের স্টেটের সংখ্যা ৫০)। ইংরেজি ভাষার ১৭১৪৭৬ ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে মাত্র ৩০০টি শব্দ শতকরা ৬৫ ভাগ সব লিখিত বিষয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
দেখা গেছে যে, কোনো বিখ্যাত মানুষ তার একটি বা দু’টি কর্মকাণ্ডের জন্য বিখ্যাত। ধরা যাক চিত্রকরদের কাহিনী। মোনালিসার জন্য লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিখ্যাত। তার অন্যান্য চিত্রকলার কথা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এ জন্যই যারা তাদের পণ্য বা সেবার ব্যবসায় বা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত, তারা ব্র্যান্ড সৃষ্টি করে প্রবল প্রচারণা চালায়। এ পদ্ধতিও সেই বিখ্যাত ‘কতিপয়ের আইনে’ আবদ্ধ।

এ আইনের আর্থিক প্রয়োগই হলো সবচেয়ে উচ্চারিত। এর দু’টি দিক। একটি অগ্রহণীয়, অপরটি সহনীয় এবং সহায়ক। এর অগ্রহণীয় দিকটি বারবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে প্রায় একই ভাষায় উল্লেখ করেছে। যেমন এর ২০১৪ সালের রিপোর্টে দেখায়, বিশ্বের এক শতাংশেরও নিচে অবস্থানকারী ধনী মানুষের সম্পদ হলো ১১০ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৮০ লাখ কোটি টাকা), যা অবশিষ্ট জনগণের সম্পদের ৬৫ গুণ বেশি। মাত্র ৮৫ জন ধনী বিশ্বের সব মানুষের সম্পদের অর্ধেকের অধিকারী। বিশ্বের ১০ জনের মধ্যে সাত জন বাস করে এমন দেশগুলোতে যেখানে গত ৩০ বছরে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে দ্রুত।

বিশ্বে ধনের বৈষম্য সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ২০০৯ সালের পর থেকে যত আর্থিক লাভ-সুযোগ-সুবিধা ছিল তার ৯৫ শতাংশ ভোগ করেছে একশতাংশ জনগণ, যারা ধনী।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক লুইস ব্রান্ডিস তাই অক্সফামের এক জরিপ উদ্ধৃত করে সতর্ক করেছেন ‘আমাদের গণতন্ত্র আছে, আবার দেশের সব সম্পদ কতিপয়ের কুক্ষিগত। এ দু’টি একসাথে হতে পারে না। এমনটি চলতে থাকলে এর ভয়াবহ ফলাফল কখনই পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না।’ তিনি বলেছেন এর ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে এবং একপর্যায়ে বর্তমান সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। উন্নত দেশগুলোর নেতৃস্থানীয় দেশে এমন অবস্থা বিরাজ করলে, তৃতীয় বিশ্বে বিশেষ করে গণতন্ত্রের নামে এবং আবডালে ক্ষমতাদখলকারী দেশগুলোর ভয়াবহ অবস্থা শুধু কল্পনীয়।

অক্সফাম সম্প্রতি ছয়টি দেশে (স্পেন, ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র) এক জরিপ চালিয়ে দেখতে পায়- সব আইন, সুবিধা ও নিয়ম-নীতিগুলো ধনীদের পক্ষে এবং নতুন আইন ও নীতিগুলো ঠিক একইভাবে প্রণীত হচ্ছে।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট আরো উদ্বেজনক। একই জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতা এই কতিপেয়রাই ভোগ করছে। দৃশ্যত ক্ষমতার পেছনে জনগণের সমর্থন আছে বলে প্রতিভাত হলেও, সত্যিকারের ক্ষমতা জনগণ ভোগ করে না। এমনকি, এর সুযোগ-সুবিধার মাত্র এক ুদ্রাংশ তাদের কাছে পৌঁছে। ধনী সুবিধাভোগীরা জনগণের সেই ুদ্র ভোগ ও সুযোগ সুবিধার বিশাল প্রচার করে, এক আকর্ষণীয় চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করে। এতে যোগ দেয় জনগণের পক্ষে তথাকথিত সুশীলসমাজ।

এই অবস্থা রোধের জন্য অক্সফাম কতগুলো সুপারিশ করেছে, যার জন্য প্রধানত রাজনৈতিক ও আর্থিক শক্তিগুলোকে একমত হতে হবে। তাদের ১৫টি সুপারিশের তিনটির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। (১) ধনকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা যাবে না; (২) প্রতিটি সরকারকে গরিব জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে; (৩) আইন এবং নজরদারি এমন হতে হবে, যেন ধনের সুষম বণ্টন হয় এবং অধিকারবঞ্চিতরা বিশেষ করে মহিলারা বাদ যেন না পড়ে। তবে সব কিছুর পরেও কতিপয়ের বিধান বা কর্মকাণ্ড থেকে কোনো পরিত্রাণ নেই, বলেছে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/198301