১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৬

জীবনের দাম নেই যেখানে

|| আশিকুল হামিদ || খুশি হতাম কোনো সুখবর জানিয়ে শুরু করতে পারলে। কিন্তু উপায় নেই। কারণ, টেলিভিশন খুললেই শুধু খারাপ খবর দেখতে ও শুনতে হয়। পত্রিকার পাতায় পাতায় থাকে অনেক বেশি খারাপ খবর। যেমন বায়ুদূষণ করার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বিশ্বে সেকেন্ড বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এক যৌথ জরিপের রিপোর্টে খবরটি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুটি গবেষণা সংস্থা। এ ব্যাপারে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতকে অবশ্য যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি আমরা। কারণ, বায়ুদূষণে শীর্ষ স্থানটি পেয়েছে ভারতের রাজধানী দিল্লি। বলা দরকার, বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতির ভিত্তিতে এই অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দিল্লির বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতির পরিমাণ যেখানে ১২২, সেখানে ঢাকার বাতাসে রয়েছে ৯০। গবেষণা রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। চীন ও পাকিস্তানসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র পাল্লা দিলেও বাংলাদেশ অন্য একটি বিষয়ে রীতিমতো স্তম্ভিত করেছে। সেটা মানুষের মৃত্যু সংক্রান্ত পরিসংখ্যান। এতে দেখা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখ ২২ হাজার চারশ’জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে! এক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরের অবস্থানেই এসেছে বাংলাদেশের নাম!
এ পর্যন্ত আসার পর পাঠকরা হয়তো ভাবছেন পরিবেশই আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু। কিন্তু না, অত উচ্চ ধরনের কোনো বিষয় নিয়ে লেখার ইচ্ছা বা সাধ্য নেই। এখানে আসলে একটি কথাই বলতে চাচ্ছি। সে কথাটা হলো, আমরা এমন এক দেশে বসবাস করছিÑ যে দেশে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই। দাম থাকলে নিশ্চয়ই শুধু ধূলাবালি খেয়ে আর আবর্জনার দুর্গন্ধের সঙ্গে উড়ে বেড়ানো রোগের জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর এক লাখ ২২ হাজার চারশ’জন মানুষের মৃত্যু ঘটতো না। মৃত্যু কিন্তু অন্য অনেকভাবেও ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার কথাই বলা যাক। ১৭ ফেব্রুয়ারি এই নিবন্ধ লেখার জন্য বসার পর সংবাদপত্রের এক রিপোর্টে দেখতে হলো, গত মাত্র ২৪ ঘণ্টায় দেশের ছয় জেলায় ১০ জনের প্রাণ গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এটুকুই সব নয়। রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, এই ১০ জনকে নিয়ে গত ছয় দিনে মোট মৃত্যু ঘটেছে ৮৫ জনের। এর অর্থ, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এটা অবশ্য প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তৈরি পরিসংখ্যান। এর বাইরে আরো কতো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে সে হিসাব হয়তো কোনেদিনই জানা যাবে না। তবে ধারণা দেয়ার জন্য অন্য একটি পুরনো পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা যেতে পারে। যাত্রী কল্যাণ পরিষদ নামের এক সংগঠন সংবাদক সম্মেলনে জানিয়েছিল, ২০১৫ সালে মাত্র এক বছরেই দেশে ছয় হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং মারা গেছে আট হাজার ৬৪২ জন। পরিসংখ্যানে আরো জানা গিয়েছিল, নিহতদের মধ্যে এক হাজার ৮০ জন ছাত্রছাত্রী, ৩০৫ জন শিক্ষক, ১৩৩ জন সাংবাদিক, ১০৯ জন চিকিৎসক, এক হাজার ৬৭৭ জন নারী, ১০৬ জন প্রকৌশলী, ৫৩৫ জন পরিবহন শ্রমিক এবং ৪১৯ জন চালক রয়েছেন। নিহত অন্যদের সংখ্যা চার হাজার ২৭৮। আহত হয়েছিলেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
এমন পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভীতিকর। পরিস্থিতির যে সামান্যও উন্নতি হয়নি সে কথা বোঝানোর জন্য মাত্র ছয় দিনে ৮৫ জনের মৃত্যুর খবরই সম্ভবত যথেষ্ট। আপত্তির একটি বড় কারণ হলো, বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল। এটা বছর কয়েক আগের কথা। অন্যদিকে বাংলাদেশে দুর্ঘটনা উল্টো বেড়েই চলেছে। যেমন ২০১৪ সালেও দেশে পাঁচ হাজার ৯২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল আট হাজার ৫৮৯ জনের। আহতদের সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৫২৪ জন। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে, সরকারের অঙ্গীকার যেখানে ছিল কমিয়ে আনার সেখানে দুর্ঘটনার সঙ্গে হতাহতদের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অবশ্য হাতের কাছে নেই। তা সত্ত্বেও বলা যায়, পরিস্থিতির অবনতিই ঘটেছে।
আমাদের আপত্তির কারণ হলো, এমন অবস্থা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, প্রতি বছর এত বেশি প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করার মতো অবস্থা ও ক্ষমতা বাংলাদেশের জনগণের নেই। মানতেই হবে, সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকে যদি প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে দুর্ঘটনা ও প্রণহানি কমানো যেতে অনেকাংশে।
আমাদের মতে, বর্তমান পর্যায়ে বেশি দরকার দুর্ঘটনার কারণগুলো লক্ষ্য করা এবং তার ভিত্তিতে প্রতিরোধমূলক ব্যস্থা নেয়া। প্রথমত, সড়ক-মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন কেউ যাতে চালকের আসনে বসতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে ত্রুটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এসবই চলাচল করতে পারছে উৎকোচের বিনিময়ে। দুর্ঘটনা কমাতে চাইলে এ ধরনের কোনো যানবাহনকে চলাচল করতে দেয়া যাবে না। একই কথা লঞ্চ-স্টিমার ও জাহাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই ব্যবস্থা নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী সামগ্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে- যার মধ্যে বাস-ট্রাক ও ট্রেন তো বটেই, লঞ্চ ও স্টিমারসহ সব ধরনের নৌযানকেও অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে দেশের সড়ক-মহাসড়কের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। কারণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা মুখে কথার খই ফোটালেও এবং টিভি ক্যামেরার সামনে জোর তৎপরতা দেখালেও কাজের কাজ কিন্তু এখনো তেমন হয়নি, দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক ঠিকঠাক হয়নি। নিরাপদে চলাচলেরও উপযোগী হয়নি। এজন্যই দু-একদিনের বৃষ্টিতে সড়ক-মহাসড়কগুলো ভেঙে পড়ে। বহুস্থানে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত ও খানা-খন্দকের। এবড়ো-থেবড়ো হয়ে পড়ে প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক। দুর্ঘটনাও ঘটে এসব কারণেই। কোনোভাবে জোড়াতালি দেয়া সড়ক-মহাসড়কগুলোর দুরবস্থার সঙ্গে রয়েছে থ্রিহুইলার, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন ও ভটভটি ধরনের নানা বাহারি নামের হালকা ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন। এগুলোও দুর্ঘটনার কারণ সৃষ্টি করে থাকে। ঘটনাক্রমে মাঝে-মধ্যে হালকা যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়া হলেও নগদ নারায়ণের বিনিময়ে সারাদেশেই প্রবল দাপটের সঙ্গে চলাচল করছে সেগুলো। যারা দেখার দায়িত্বে রয়েছেন তারা ব্যস্ত থাকেন ঘুষের অর্থ আদায়ের জন্য। আর সে কারণেই যানবাহনগুলো যেমন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছে তেমনি দুর্ঘটনাও ঘটাচ্ছে প্রতিদিন।
আমরা অবশ্য মনে করি না যে, কেবল হাল্কা যানবাহন নিষিদ্ধ করা হলেই দুর্ঘটনা এক লাফে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। কারণ, দুর্ঘটনার অন্য কিছু অনস্বীকার্য কারণও রয়েছে। চালকদের অদক্ষতা, অসাবধানতা এবং পাল্লা দেয়ার ও সামনের গাড়িকে ওভারটেক করার প্রবণতা এরকম একটি বড় কারণ। বহু চালকেরই যে প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নেই, সে কথা জানার জন্য গবেষণা বা অনুসন্ধানের দরকার পড়ে না। এ ধরনের চালকরা এমনকি রাজধানীতেও বছরের পর বছর ধরে দিব্বি গাড়ি চালাচ্ছে। ধরা পড়লে উৎকোচ দিয়ে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে তারা। সুতরাং সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে হলে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে লাইসেন্সহীন ও অদক্ষ কোনো লোক গাড়ি চালাতে না পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে ত্রুটিযুক্ত যানবাহন। নগদ উৎকোচের বিনিময়ে ত্রুটিযুক্ত, এমনকি লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা শত শত যানবাহনও দেশের সব অঞ্চলে চলাচল করছে। একই কথা লঞ্চ ও স্টিমারের বেলায়ও সমান সত্য। সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ২০-২৫ বছরের পুরনো যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়- যেমনটি করা হয়েছে অতি সম্প্রতিও। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভাঙা ও লক্কড় মার্কা গাড়িকে যেমন নতুন রং লাগিয়ে সড়ক-মহাসড়কে নামিয়ে দেয়া হয় তেমনি অনেক লঞ্চকেও নতুন রং লাগিয়ে এবং কোনোভাবে ঝালাই বা মেরামত করেই নদীতে ভাসিয়ে দেন মালিকেরা। তারা শুধু ভাড়ার টাকা গুনতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন, মানুষের জীবন নিয়ে সামান্যও চিন্তা করেন না।
সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বলা দরকার, সত্যিই দুর্ঘটনা ও মানুষের মৃত্যু কমাতে এবং পর্যায়ক্রমে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাইলে ত্রুটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহনকে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করতে দেয়া যাবে না। একযোগে ট্রাফিক আইনেরও কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। চালকরা যাতে আইন মেনে চলে এবং পাল্লা দিতে বা ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটায়, বাস নিয়ে সোজা খাদে চলে না যায়- এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে নজরদারির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রতিও। কারণ, উৎকোচের সঙ্গে তাদের সরাসরি সম্পর্ক থাকার প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এমনকি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও। এজন্যই বাস-মিনিবাস তো বটেই, ফিটনেসবিহীন অনেক লঞ্চ-স্টিমারও বাধাহীনভাবেই চলাচল করতে পারছে। একই কারণে পদক্ষেপ নিতে হবে সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপারে, পরিকল্পনাও নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী। এভাবে সব মিলিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হলেই সড়ক-মহাসড়কের পাশাপাশি নৌপথেও দুর্ঘটনা কমে আসতে পারে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তেমন পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ নেয়া দরকার অনবিলম্বে, যাতে আর কোনো দুর্ঘটনায় মানুষকে জীবন হারাতে না হয়। যাতে মাত্র ছয়দিনেই ৮৫ জনের মৃত্যু না ঘটে এবং বলতে না হয় যে, বাংলাদেশে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই।
বলা দরকার, এজন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। সরকারকে বুঝতে হবে, জনগণ শুধু আশ্বাস ও মিষ্টি কথা শুনতে চায় না। তারা কাজ দেখতে চায়। বড় কথা, ক’দিন পর পর- বাস্তবে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা এবং শত শত স্বজনের মৃত্যু ও লাশ দেখতে চায় না তারা। আমরা আশা করতে চাই, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং কেবলই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকার পরিবর্তে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য বাস্তবেও তৎপর হয়ে উঠবে।
http://www.dailysangram.com/post/272355-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%A8