১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৫

জনশক্তি রফতানিতে প্রতারণা বাড়ছে: দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব তরুণেরা

জনশক্তি রফতানি খাতে প্রতারণার ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চাকরির সোনার হরিণ ধরার আশায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসছেন হাজার হাজার শ্রমিক। কয়েক লাখ শ্রমিককে নির্যাতন সইতে হচ্ছে বিভিন্ন দেশের কারাগারে। শুধু বিদেশে গিয়েই নয়, দেশের মাটিতেও প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন বিদেশ গমনেচ্ছু তরুণেরা।
দেশে এখন জনশক্তি রফতানির সাথে জড়িত এক হাজার ৭১টি রিক্রুটিং এজেন্সি। এর মধ্যে মানবপাচার, কর্মী পাঠাতে অনিয়ম, হয়রানি ও জালিয়াতির অভিযোগে ৮৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বিদেশে প্রতারিত হয়ে প্রতি বছর কত কর্মী দেশে ফেরত আসছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এ সংখ্যা কয়েক হাজার হবে বলে মনে করেন রফতানি সংশ্লিষ্টরা। আর এ ধরনের প্রতারণার কারণে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেশের সুনাম।
অন্য দিকে দেশের মাটিতেই প্রতারিত হওয়ার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, মালদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমিক পাঠানোর নাম করে দালালেরা গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অগ্রিম টাকা আদায় করছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তাদের অনেককেই বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। এ অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে। তাদের নিয়োগ করা দালালেরা বিদেশ গমনেচ্ছু এসব মানুষের টাকা নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে হতদরিদ্ররা হচ্ছেন সর্বস্বহারা।
এ দিকে চলতি বছরের প্রথম দেড় মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষাধিক কর্মী পাড়ি জমিয়েছেন এ সময়। এর মধ্যে বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবেই অর্ধ লাখ কর্মী গেছেন। এর পরই রয়েছে ওমান, কাতার ও বাহরাইনের নাম। বিদেশে কর্মী নিয়োগের এ সুযোগেই চলছে প্রতারণা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুরের বাসিন্দা নাজমুল শেখ ও মামুন টেলিফোনে নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা সৌদি আরব যাওয়ার জন্য দু’টি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠান দু’টির কোনোটিই তারা চেনেন না। এলাকার দালাল শহীদুলের মাধ্যমে তারা বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং গ্রামেই অগ্রিম টাকা লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে মামুন সৌদি আরব যাওয়ার জন্য আত্মীয়স্বজনের জিম্মায় পাসপোর্ট ও দুই লাখ টাকা তিন মাস আগে কোনো রসিদ ছাড়াই দেন। দালাল বলেছে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার আগেই তার ভিসা লেগে যাবে। কিন্তু এখনো তার ভিসাই লাগেনি। তাই খোঁজ নিতে তিনি ঢাকায় এসেছেন। কত টাকা খরচ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাড়ে ছয় লাখ টাকার চুক্তিতে তাকে সৌদি আরব পাঠাতে দালালের সাথে তার বাবার কথা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেশেই পরিশোধ করতে হবে। বাকি এক লাখ টাকা সৌদি আরব যাওয়ার পর পরিশোধ করতে হবে। মামুন জানান, ইতোমধ্যে তিন দিনের ট্রেনিং ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট গোপালগঞ্জে শেষ হয়েছে। দালাল শহীদুল তার গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার পরও তার আশঙ্কা কাটছে না। কেননা ঢাকায় এসে অনেকের মুখেই টাকা মার যাওয়ার কথা শুনতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেছেন তিনি। মামুনের সাথে ঢাকায় আসা আরেক বিদেশগামী নাজমুল শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি এর আগে পল্টনের আল জাহাঙ্গীর নামের একটি ট্রাভেলসে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য টাকা ও পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। দেড় মাস ঘোরানোর পর ভিসা না আসায় তিনি সেখান থেকে পাসপোর্ট তুলে এখন আরেক প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়েছেন। তবে তার দালাল তাকে বলেছেন, ইলেকট্রনিকসের কাজে সৌদি আরব যেতে তার সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে থাকা-খাওয়া বাদ দিয়ে তার প্রতি মাসে আয় হবে ৫০ হাজার টাকা। তবে তার বিদেশ যাওয়ার জন্য দালালকে কত টাকা দেয়া হয়েছে তা তিনি জানেন না বলে জানান নাজমুল শেখ।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিদেশগামী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই এখন জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সদস্য বিভিন্ন রিক্রুটিং অফিসে টাকা ও পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরছেন। কিন্তু বিদেশ যেতে পারছেন না। কেউ কেউ আবার দালালরূপী প্রতারকের খপ্পরে পড়ে জমা দেয়া টাকাই খুইয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, চুক্তি মোতাবেক কেউ কেউ বিদেশ যাওয়ার পরও সঠিক কাজ পাচ্ছেন না। লোভনীয় বেতনের অফার দিলেও সেখানে গিয়ে তার কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছে না।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার কার্যনির্বাহী কমিটির এক নেতা নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বিদেশগামীদের সাথে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে না, এমনটি বলব না। তবে আগে যেভাবে দালালেরা টাকা হজম করে দিত এখন সেই রকম আর নেই। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন প্রতারকদের ধরার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত টাস্কফোর্স, র্যাব, পুলিশ ডিবি ও সিআইডি বেশ তৎপর। এ ছাড়া প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেনÑ কোনোভাবেই যেন বিদেশগামীরা প্রতারণার শিকার না হন।
তবে বায়রার অপর এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি করলেও একশ্রেণীর আদম ব্যাপারী এখনো অবৈধ পথে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে আদম পাচার অব্যাহত রেখেছে। এই চক্রের অপতৎপরতা বন্ধ না হলে বৈধভাবে জনশক্তি রফতানি যেমন প্রসারিত হবে না, তেমনি বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার গতিও বাড়বে না।
উল্লেখ্য, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৮১ হাজার ৪৩৪ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৪২ হাজার ২৭২ জন। এর পরই রয়েছে ওমান। দেশটিতে কর্মী গেছেন ১০ হাজার ৬২৪ জন। কাতারে গেছেন ৯ হাজার ৩৯২ জন। অন্য দিকে ১ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে অর্ধ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/196766