১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৪

রাজধানীর গণপরিবহন: মাসে ১২ কোটি টাকা চাঁদাবাজি

রাজধানীর গুলিস্তান টার্মিনাল ছাড়ার আগেই গাজীপুর চৌরাস্তা রুটের ‘প্রভাতী বনশ্রী’ পরিবহনের একটি বাসের জন্য চাঁদা দিতে হয় সাড়ে ৪শ’ টাকা, যা ‘টার্মিনাল চাঁদা’ নামে পরিচিত। এর বাইরে সিটি কর্পোরেশনের ইজারাদার ও সিরিয়ালের জন্য দিতে হয় আরও একশ’ টাকা। সব মিলিয়ে সাড়ে ৫শ’ টাকা পরিশোধের পর এ রুটে একটি বাস রাস্তায় নামে। এছাড়া টার্মিনাল থেকে বের হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যেতে ৬টি স্থানে আরও তিনশ’ টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে প্রতি যাত্রা বা ট্রিপে খরচ হয় সাড়ে ৮শ’ টাকা। এই রুটে একটি ট্রিপে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিনশ’ বাস চলাচল করে। এই হিসাবে ঢাকা-গাজীপুর রুটে বাস মালিকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে চাঁদা উঠানো হয় প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এই অর্থ ভাগাভাগি হয়, সরকারি দল সমর্থিত বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয় পলিটিক্যাল ক্যাডার, পুলিশ ও সন্ত্রাসীসহ ৬ ধাপে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।


জানতে চাইলে প্রভাতী বনশ্রী রুটের একটি বাসের মালিক সোহরাব মিয়ার দেয়া তথ্যেও উল্লিখিত তথ্যের সত্যতা মিলে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিন যে ভাড়া আদায় হয় তার বড় একটি অংশ রাস্তায় চলে যায়। পথে পথে চাঁদা দিতে গিয়ে দিনশেষে তিনি হাতে পান মাত্র ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা। এরপর আবার প্রতি মাসে মালিক সমিতির নির্ধারিত চাঁদা রয়েছে। সরকারি দল সমর্থিত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রতিটি বাস থেকে এ চাঁদা তুলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সোহরাব মিয়ার তথ্যমতে, শুধু গুলিস্তান থেকে গাজীপুর রুটেই সাড়ে ৩শ’ গাড়ি চলাচল করে। আর এসব গাড়ি থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকা।

রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) গুলিস্তান থেকে সরেজমিন প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব১৪-৩৩৯৯ নম্বরের বাসে গাজীপুুর ভ্রমণের সময় চাঁদাবাজির ওই সব তথ্যের মিল পাওয়া যায়। গুলিস্তান থেকে বাসটি ছাড়ার পরপরই পল্টন মোড়ে এক যুবকের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন বাসটির কন্ডাক্টর সিরাজ। একই অবস্থা দেখা গেল বাড্ডার নতুনবাজার, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট এবং আজমপুরে। প্রতিটি স্পটেই এক থেকে দুই যুবক হাত উঁচিয়ে বাস থামার নির্দেশ দিলে কন্ডাক্টর তাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে দেখা যায়। পরিচয় পেয়ে প্রথমে কথা বলতে রাজি না হলেও পীড়াপীড়ির এক পর্যায়ে বাসটির কন্ডাক্টর সিরাজ জানান, লাইনম্যানের নামে ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠন এ টাকা নেয়।

একই চিত্র পাওয়া গেছে মতিঝিল-মিরপুর রুটেও। এই রুটে শিকর, সময় নিয়ন্ত্রণ ও দিশারীসহ কয়েকটি পরিবহনের প্রায় এক হাজার বাস চলাচল করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি ট্রিপে একটি বাসের মালিককে কমপক্ষে সাড়ে ৮০০ টাকা গুনতে হয়। এর মধ্যে টার্মিনাল চাঁদা ৪৫০ টাকা এবং সিরিয়াল ও সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দিতে হয় ৩৩০ টাকা। এ হিসাবে এই রুটে প্রতি মাসে গড়ে চাঁদা ওঠে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। অর্থাৎ ঢাকা-গাজীপুর ও মতিঝিল-মিরপুর রুটে মাসে গড়ে চাঁদা ওঠে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

ঢাকা-গাজীপুর ও মতিঝিল-মিরপুরসহ রাজধানীর মোট ২৮টি রুটেও প্রায় একই ধরনের চাঁদাবাজির চিত্র পাওয়া গেছে। প্রতিটি রুটের দূরত্ব অনুযায়ী চাঁদাবাজির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উল্লিখিত গুলিস্তান ও মতিঝিলসহ রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী এ পাঁচ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাস। প্রতিটি বাস থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে ১২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা ওঠে।

এ ছাড়া রাজধানীতে চলা সিটিং সার্ভিসের প্রতিটি কোম্পানি থেকে মালিক সমিতির নামে প্রতি মাসে ৩ হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এ টাকার ক্ষুদ্র একটি অংশ সমিতির নামে ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। আর বড় অংশই চলে যাচ্ছে সমিতির নামধারী নেতাদের (ক্ষমতাসীন দল) পকেটে। এর বাইরে পুলিশ খরচা বাবদ গাড়িপ্রতি ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দিতে হয়। এ টাকা যখন-তখন পুলিশের রিক্যুজিশন বন্ধ করার জন্য নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির সংশ্লিষ্টরা।

সাধারণ বাস মালিক ও শ্রমিকদের অনেকে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের পেছনে ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, যখন যে দল সরকারে আসে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ সেই দলের পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও তাদের ক্যাডারদের হাতেই থাকে। তাদের ভাষায়, ‘পরিবহনের টাকা বাতাসে ওড়ে, আর যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা এ টাকা হাতিয়ে নেন।’ সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পরিবহন চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রাজধানীতে খুনোখুনির ঘটনাও কম হয়নি। কিন্তু পরিবহন চাঁদাবাজি কখনও থেমে থাকেনি।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই পরিবহন ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আর এ কারণে গত ৫ বছরে নগরীতে জনসংখ্যা বাড়লেও কমেছে গণপরিবহনের সংখ্যা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাবেক নেতা সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, গত তিন বছরে রাজধানীতে প্রায় দেড় ডজন নতুন রুটে বাস নেমেছে। এসব রুটের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহনগুলোর মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হাতে। দলীয় পরিচয় ছাড়া নতুন কোনো ব্যবসায়ী এসব রুটে বাস নামাতে চাইলে প্রথমেই তাদেরকে সংশ্লিষ্ট রুট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ধার্য করে দেয়া হয় মোটা অংকের টাকা। আর প্রথম ধাক্কায় মোটা অংকের টাকার কথা শুনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন নতুন ব্যবসায়ীরা।

সড়ক পরিবহনের সাবেক ওই নেতার দাবি রাজধানীতে নতুন নতুন রুটে বাস যুক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে কমেছে গাড়ির সংখ্যা। তার দাবি, আগে নগরীতে বড়-ছোট মিলিয়ে ৯ হাজারেরও বেশি বাস চলত। এখন বাস কমে সাড়ে সাত হাজারের দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কয়েকশ’ বাস আবার মেরামতের জন্য মাসের বেশিরভাগ সময় থাকে ওয়ার্কশপে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাবতলী বাস টার্মিনালে চাঁদা আদায় করছে আতিক এবং মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ। মহাখালী বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সাদেকুর রহমান হিরু ও শহীদুল্লাহ সদুর হাতে। আগে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল খায়রুল আলম মোল্লার হাতে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য নিয়ে খায়রুল আলম খুন হওয়ার পর এখন সায়েদাবাদে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে আছে আবুল কালাম আজাদ, নয়ন, করম আলী, মনির চৌধুরী, আলী রেজা ও আমির হোসেনের হাতে। এ ছাড়া ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা। ওই নেতার ঘনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত বাবুলের হাতে টার্মিনাল চাঁদাবাজির পুরো নিয়ন্ত্রণ।

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটি মিথ্যাচার। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে মালিক সমিতির কাছ থেকে কেউ টাকা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি কেউ এর প্রমাণ দিতে পারেন তবে তিনি ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবেন।

নগরীতে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া রোডস্টার নামে একটি পরিবহন কোম্পানির পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, ‘চাঁদাবাজি আর ঘুষ হচ্ছে বাতাসের মতো। গায়ে লাগলে বোঝা যায়, বাতাস লাগছে, চোখে দেখা যায় না।’ তার ভাষায়, ‘পরিবহন সেক্টরের চাঁদার টাকা বাতাসে ওড়ে।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবেক ওই পরিবহন মালিক বলেন, ২০০৫ সাল থেকে তিনি পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমদিকে ব্যবসা ভালো ছিল। ব্যবসা ভালো থাকায় দিন দিন তাদের কোম্পানির গাড়ির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের কোম্পানির বাসগুলো লিজের নামে একপ্রকার জোর করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে তাদের মর্জি হলে কিছু টাকা দেয়, আবার মাসের পর মাস দেয় না। ক্ষমতাসীন দলের কারা গাড়িগুলো নিয়েছে জানতে চাইলে সাবেক ওই পরিবহন ব্যবসায়ী বলেন, ‘বউ-বাচ্চা নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। কোনোভাবে দিন কাটছে। নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চাই না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগরীর বেশ কয়েকটি রুটের পরিবহন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ক্যাডার ও পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে লাভের টাকা মালিকের পকেটে যাওয়ার আগে পথেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এখন চাঁদা দিতে হয় এলাকাভিত্তিক পলিটিক্যাল ক্যাডারদেরও। নির্দিষ্ট পার্কিংয়ের স্থান না থাকায় রাতে সরকারি রাস্তায় গাড়ি রাখলেও থানা পুলিশের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক পলিটিক্যাল ক্যাডারদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। সাধারণ মালিক ও শ্রমিকরা বলেন, চাঁদার নির্ধারিত এ টাকা দিতে না পারলে রাস্তায় গাড়ি নামানো যায় না। টাকা না দিলে অমিটের নামে দিনের পর দিন গাড়ি বসিয়ে রাখা হয়। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, সিটি সার্ভিস ও শহরতলীর ২৮টি রুটে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুমোদন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ শুক্রবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি একেবারে হয় না, এ কথা বলা যাবে না। কোথাও কোথাও অভিযোগ যখন ওঠে তখন আমরা অ্যাকশনে যাই। তিনি বলেন, সমিতির জন্য প্রতি গাড়িতে চাঁদা নির্ধারণ করা আছে। ওই নির্ধারিতে চাঁদার বাইরে সমিতি কোনো টাকা নেয় না বলে তিনি দাবি করেন। তবে পরিবহন মালিক সমিতির এ নেতা বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে কোম্পানির নামে চলাচলরত গণপরিবহনে বিভিন্ন সার্ভিসের কথা বলে বাড়তি টাকা তোলার অভিযোগ পাওয়া যায় বলে তিনি যুগান্তরকে জানান। তবে এসব কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় সমিতি ব্যবস্থা নিতে পারে না। তারপরও গুরুতর অভিযোগ উঠলে কোম্পানির পরিচালকদের ডেকে কথা বলা হয়।

সাধারণ বাস মালিক-শ্রমিকরা বলেছেন, যখন যে দল সরকারে আসে, চাঁদার নিয়ন্ত্রণ সেই দলের পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও তাদের ক্যাডারদের হাতেই থাকে। তবে বর্তমানে এ অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে এলাকাভিত্তিক পলিটিক্যাল ক্যাডারও। সাধারণ মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, নানা অজুহাতে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। আর চাঁদার নির্ধারিত এ টাকা দিতে না পারলে রাস্তায় গাড়ি নামানো যায় না। টাকা না দিলে ক্ষমতাসীন দলের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো অমিটের নামে দিনের পর দিন গাড়ি বসিয়ে রাখে। নানাভাবে হয়রানি করে।
http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/18/102005/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87-%E0%A7%A7%E0%A7%A8-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6%E0%A6%BE