১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৫

গ্যাসের দাম নিয়ে উভয় সংকট

গ্যাসের দাম নির্ধারণ নিয়ে উভয় সংকটে সরকার। বর্তমানে গ্যাস আমদানির কোনো বিকল্প নেই। আগামী বছরের জুলাই থেকে আমদানি করা গ্যাস ভোক্তারা ব্যবহার করতে পারবেন বলে আশা করছে সরকার। কিন্তু দেশীয় গ্যাসের চেয়ে আমদানি করা গ্যাসের দাম পাঁচগুণ বেশি। এত বেশি দামে আমদানি করা গ্যাস বর্তমানে নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে সরকারকে বছরে কমবেশি ৩০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি গুনতে হবে, যা বহন করা সরকারের পক্ষে অনেকটাই দুরূহ। এদিকে দাম যদি দ্বিগুণও বাড়ানো হয়, তাহলেও সরকারকে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি গুনতে হবে। ওদিকে দাম বাড়ালে শিল্প উৎপাদনসহ সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। গ্যাসের দাম নির্ধারণ নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, দু'বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনী বছরে কোনো সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর ঝুঁকি নেবে না। কারণ এতে জনমতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে চলতি বছরেই গ্যাসের দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এদিকে, বছরে এক দফার বেশি দাম বাড়ানোও মুশকিল। কারণ এতে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। সার্বিকভাবে আমদানি করা গ্যাস ও দেশীয় গ্যাসের সমন্বিত দাম নির্ধারণ নিয়ে উভয় সংকটে সরকার।

সূত্র বলছে, শিগগিরই গ্যাসের দাম এক দফা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিভিন্ন খাতে দাম বৃদ্ধির খসড়া চূড়ান্ত করেছে কয়েক মাস আগে। জানা গেছে, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বাড়তে পারে।

বর্তমানে সারাদেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৫০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। ৮০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি। প্রাথমিক পর্যায়ে আমদানি করা হবে ৫০ কোটি ঘনফুট। আগামী বছরের মাঝামাঝি জাতীয় গ্রিডে এই আমদানি করা গ্যাস যুক্ত হবে। পরবর্তী বছরেই আরও ৫০ কোটি ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা গ্যাস যত বেশি যুক্ত হবে, গ্যাসের দামও তত বাড়তে থাকবে। প্রশ্ন উঠেছে, এত বেশি দামে গ্যাস ব্যবহারের ক্ষমতা শিল্প মালিক ও সাধারণ গ্রাহকদের আছে কি-না। একজন শিল্প মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে জানান, এভাবে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকলে পোশাক রফতানিতে ধস নামবে। কারণ প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারবেন না।

বিইআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম নির্ধারণের বিষয় নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির ভার সরকার বহন করতে পারবে না। একই সঙ্গে শিল্প মালিক ও সাধারণ গ্রাহকরাও অসহনীয় কোনো দাম বৃদ্ধি মেনে নেবেন না। ফলে আমদানি করা গ্যাস ব্যবহার শুরু হলে দাম সমন্বয় কীভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। যাই করা হোক না কেন, সবকুল রক্ষা করেই করতে হবে।

আমদানি করা গ্যাসের ব্যবহার শুরু হলে দামের ক্ষেত্রে কী রকম প্রভাব পড়তে পারে সেটি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘনফুট) গ্যাসের দাম ১৭৩ টাকা (২.১৭ ডলার)। দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি যোগ হলে গ্যাসের দাম হবে প্রতি ইউনিট ৯২১ টাকা। আর ৫০ কোটি ফুট এলএনজি যোগ হলে গ্যাসের দাম হবে প্রতি ইউনিট ৩৪৮ টাকা। আমদানি মূল্য ও স্থানীয় পর্যায়ের শুল্ক ধরে এ দাম হিসাব করা হয়েছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এলএনজির ওপর ধার্য শুল্ক ও কর না নিলে এ দাম কমবে।

এলএনজি আসার পরও সরকার যদি বর্তমান দরেই (প্রতি হাজার ঘনফুট ১৭৬ টাকা) ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করে তাহলে বছরে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে। দিনে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি ব্যবহার হলে বছরে ভর্তুকি গুনতে হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি যোগ হলে ভর্তুকি গুনতে হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে গ্যাসের দাম এক দফা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। যে কোনো সময় দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে পারে বিইআরসি। বর্তমান মূল্যের চেয়ে গ্যাসের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। এই মূল্য বৃদ্ধির বিরোধিতা করছেন ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তরা। তারা বলছেন, প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে, যা পণ্য রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়বে।

বর্তমানে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছাড়া দেশীয় গ্যাসের প্রতি ইউনিট উৎপাদনে খরচ হয় ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। এসডি এবং ভ্যাটসহ উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ২৭০ টাকা ৪৬ পয়সা। তবে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করা হয় ১৭৬ টাকা ১৫ পয়সা।

দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হয়। এর ৬২ শতাংশ আসে বিদেশি কোম্পানির (আইওসি) মালিকানাধীন গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। চুক্তি অনুসারে বর্তমানে এই ৬২ শতাংশের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ বাংলাদেশের অংশ। বাকি অংশ আইওসির। আইওসির অংশ প্রতি হাজার ঘনফুট গড়ে ২৪০ টাকায় কিনে নেয় পেট্রোবাংলা। আইওসিগুলোর কর ও শুল্কও পরিশোধ করে পেট্রোবাংলা। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উত্তোলিত গ্যাসের উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। প্রতি ইউনিটে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সব মিলিয়ে গড়ে গ্যাসের উৎপাদন ব্যয় ইউনিটপ্রতি ১২১ টাকার মতো। কিন্তু বিক্রয় পর্যায়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ কর ও শুল্ক ধার্য থাকায় গ্যাসের দাম বেড়ে হয় ২৭০ টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বর্তমানে ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানির বিকল্প নেই। এর ফলে গ্যাসের দাম কয়েক গুণ বাড়বে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে এক দফায় দাম বৃদ্ধি করা যৌক্তিক হবে না। তাহলে শিল্প-বণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যাবে। পর্যায়ক্রমে দাম বাড়াতে হবে। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট কর্মকৌশল প্রণয়ন করা উচিত। কোন বছর কতটুকু বাড়ানো হবে, সরকার কতটুকু ভর্তুকি দেবে, তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। যেন উদ্যোক্তারা আগেই জানতে পারেন সামনে গ্যাসের দাম কত হবে। তারা সেভাবেই প্রস্তুতি নেবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, জ্বালানি ঘাটতির সাময়িক সমাধানে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য এলএনজির ওপর বেশি নির্ভরশীলতা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ এতে গ্যাসের দাম সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। অর্থনীতির জন্য তা শুভ ফল বয়ে আনবে না। বিকল্প হিসেবে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিতে বলেছেন তিনি।

জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এলএনজি আমদানির পর গ্যাসের দাম কীভাবে নির্ধারণ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনার জন্য শিগগিরই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে জ্বালানি বিভাগ। এর পর করণীয় ঠিক করা হবে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে জানিয়েছেন, এলএনজি আসার পর গ্যাসের দাম বাড়বে। এ জন্য ব্যবসায়ীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে মূল্য একবারে না বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে সমন্বয় করা হবে। সরকার ভর্তুকি দেবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সবদিক বিবেচনা করা হচ্ছে।
- See more at: http://bangla.samakal.net/2017/02/19/271344#sthash.MbMylj7C.dpuf