১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪২

প্রশ্ন ফাঁসের মহামারি, আক্রান্ত পরীক্ষা ব্যবস্থা

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা। প্রশ্ন ফাঁস ব্যাধিতে আক্রান্ত পুরো শিক্ষাখাত। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসে শুধু পরীক্ষা ব্যবস্থাকেই বিদ্ধ করছে না, এতে সুদূরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। চলতি এসএসসি পরীক্ষার গণিতের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর তুমুল আলোচনা-সমালোচনা এ নিয়ে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, তদন্তে প্রমাণ মিললে পরীক্ষা বাতিলের চিন্তা করা হবে। এমন আলোচনার মধ্যেই আরো একটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের খবর প্রকাশ হয়েছে। গত বছর পিইসি বাংলায় ৫৩ শতাংশ, ইংরেজিতে ৮০ শতাংশ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে খোদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে তথ্য মিলেছে। গত বছর প্রশ্নফাঁস নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সেখানে তারা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের উদাহরণ তুলে আনেন। সংস্থাটি দাবি করে, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ৪০টি ধাপে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। প্রশ্নপত্র তৈরি করা থেকে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ পর্যন্ত মোট ৪০টি ধাপের মধ্যে ১৯টি ধাপ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে। এই ধাপগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু সংখ্যক লোক। তাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি অংশ, কোচিং সেন্টার এবং প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপানো ও বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ। তবে সরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তা ও প্রশ্রয় ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের ও পরীক্ষার গুরুত্ব ও সংখ্যাভেদে অর্থের লেনদেন হয়। সাধারণত ব্যক্তিপর্যায়ে ২০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা আর গোষ্ঠীগত পর্যায়ে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত রফা করা হয়।
এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের গবেষণা ছিল প্রশ্নফাঁসের একটি চিত্র। বিস্তর চিত্র আরো ভয়াবহ। এ রিপোর্টটি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল আমলে না নিয়ে তা অস্বীকার করলো। এখন আমরা কী দেখছি। তিনি বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সদিচ্ছা ছাড়া এই ব্যাধি বন্ধ করা এখন সম্ভব না বলেও জানান তিনি। কারণ, এর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের লোকজন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশ্নফাঁসের খবর আসার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ আসতে থাকে। তার মধ্যে এক ধরনের বিপন্নবোধ কাজ করে। ধারণা হয়, সবাই পাচ্ছে আমি কেন পাচ্ছি না? সবাই মনে হয় আমার চেয়ে ভালো ফল করে ফেলবে। এতে সেও আগে প্রশ্ন পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে হলে আগে এর বাজার নষ্ট করতে হবে। তার জন্য কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর প্রশ্নফাঁসের ব্যাধি মহামারি আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, সবার মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতাই প্রশ্নফাঁসের অন্যতম কারণ। সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন না ঘটলে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব না। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে সৃজনশীল পদ্ধতি কীভাবে আরো সহজলভ্য করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিক মানবজমিনকে বলেন, এটা একটা ভয়াবহ ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। প্রশ্নফাঁস হওয়ার পর এক শ্রেণি পায় আরেক শ্রেণি পায় না। এতে না পাওয়াদের মধ্যে চরম হতাশা তৈরি হয়। এতে পরবর্তীতে তার মধ্যে প্রশ্ন সংগ্রহ করার আগ্রহ জন্মায়। দ্রুত এই ব্যাধি দূর করার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এসএমএ ফায়েজ বলেন, প্রশ্নফাঁস যে শুধু শিক্ষার ক্ষতি করছে তা নয়, এটা সামাজিক অবক্ষয় তৈরি করছে। ছাত্রজীবনে একজনকে দুর্নীতি শেখানো হচ্ছে, যা সে কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। যা দেখে অন্য কেউ যেন আর সাহস না দেখায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, পরীক্ষার মাঝখানে খবর এলো প্রশ্নফাঁস হয়েছে। তখন শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি বিঘ্নিত ও তাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে নষ্ট করে দেয়। তিনি বলেন, সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পড়াশোনার। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস হওয়ার অন্যতম কারণ পাবলিক ডিমান্ড। ডিমান্ড না থাকলে কখনো সাপ্লাই হয় না। এই ডিমান্ড তৈরি করেছেন অভিভাবকরা। প্রশ্নফাঁস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, শিক্ষামন্ত্রী ইচ্ছে করলে এটা থামাতে পারবেন না। কারণ, দেশে এখন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য। এই কোচিং বাজার ঘনঘন পাবলিক পরীক্ষা তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, আজকে যে শিশুটি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে পরবর্তীতে সে মহাদুর্নীতিবাজ হবে। তাকে থামানোর ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাছে থাকবে না। তিনি বলেন, যারা প্রশ্নফাঁস করছে এবং যারা নিচ্ছে তাদের তালিকা করে দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হোক। যাতে সামাজিক লজ্জার কারণে পরবর্তীতে কেউ এ কাজ করতে সাহস না দেখায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়া মানে একজন শিক্ষার্থীকে অপরাধী করে তোলা। যার মাধ্যমে সে পরবর্তীতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অপরাধবোধকে কাজে লাগাবে। তার মধ্যে ধারণা জন্ম নেবে, পড়ালেখা না করেই পরীক্ষা দেয়া যায় এবং ভালো ফল করা যায়। তিনি বলেন, একসময় নকল প্রতিরোধ ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হতো। এখন সেটি লক্ষ্য করা যায় না। এর অন্যতম কারণ সবার মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার অসম প্রতিযোগিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিদ ড. মেহজাবীন হক বলেন, প্রশ্নফাঁসের সবচেয়ে শিকার শিশুরা। শিশু বয়সেই তার মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটানো হচ্ছে। আমরা নিজেরাই তাদের হাতে ফাঁস প্রশ্নপত্র তুলে দিয়ে দুর্নীতির হাতেখড়ি করছি। যে সময় তারা বই নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেই সময় সে পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষায় থাকে। এমনও অনেক হয়, সে যে প্রশ্নপত্রটি আগের রাতে পেল পরের দিনের পরীক্ষায় হয়তো তা মিললোই না। তখন সেটা তার জন্য আরো হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=54148&cat=2/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8-%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF,-%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B