ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। ট্রেনের জানালা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে নিজের সন্তানকে তুলে দিচ্ছেন বাবা। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
১৭ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ৭:৪৭

ঈদ যাত্রার তাড়ায় গাছাড়া রেল

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর কঠোর অভিযানের মুখে সড়ক-মহাসড়কে বাস কমে যাওয়ায় এবার ঈদ যাত্রায় বাড়তি চাপ পড়ছে রেলপথে। কিন্তু এবার ঈদ উপলক্ষে রেলওয়ের যাত্রী পরিবহনের প্রস্তুতি অন্যবারের মতোই। ৮৫ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে এবারও ঈদের আগে-পরে বাড়তি যাত্রী পরিবহনের প্রস্তুতি শেষ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের মূল স্রোত শুরু হওয়ার আগেই মহাসড়কে বাসের তীব্র সংকট, যানজট, ফেরিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এর ওপর একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা বাড়িয়েছে আতঙ্ক। হঠাত্ ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ভয় থাকলেও যাত্রীরা সড়ক-মহাসড়কের চেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে রেলপথকে।

সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে খুদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ ও বিআরটিএ। ফিটনেসবিহীন বাস মহাসড়কে চলতে না দেওয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর। ফলে অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকরা রাজধানী থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ বাস চালানো বন্ধ রেখেছে। এ অবস্থায় অনেক যাত্রী ট্রেনের আগাম টিকিট কেটে রেখেছে কঠোর পরিশ্রম স্বীকার করেও। আর কষ্টের সেই আগাম টিকিটে ট্রেনে ঈদ যাত্রা শুরু হচ্ছে আজ শুক্রবার।
আজ থেকে আগামী ২১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যাবে ৩১টি আন্ত নগর ট্রেন। সেই সঙ্গে ১৮ আগস্ট থেকে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি পথে ছুটে যাবে বিশেষ ট্রেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম রেলে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩৫০ ট্রেনে প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে। এবার ঈদ যাত্রায় পরিবহন করা হবে দিনে তিন লাখ যাত্রী। ঈদ মৌসুমে বাড়তি যাত্রী পরিবহনের জন্য ১৫০ কোচ সংযোজন করা হচ্ছে পাহাড়তলী ও সৈয়দপুর কারখানা থেকে। স্বাভাবিক সময়ে এক হাজার ২৫২টি কোচ থাকে, ঈদ যাত্রায় থাকবে এক হাজার ৪০২টি। রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ২০টি ইঞ্জিন বাড়িয়ে ২২৯টি করা হচ্ছে।
সড়কে বাস চলাচলে হঠাত্ তীব্র সংকটের মুখেও রেলপথে ঈদ যাত্রায় অন্যান্যবারের চেয়ে বাড়তি কোনো প্রস্তুতি না রাখার কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি রেলওয়ের বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহায় যাত্রী পরিবহনের জন্য এক মাস আগেই ২২ জুলাই প্রস্তুতিসভা করে আগাম টিকিট বিক্রি, অতিরিক্ত কোচ ও ইঞ্জিন সংযোজনের সিদ্ধান্ত নিই। তবে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর মহাসড়কে বাস সংকট পরিস্থিতি হঠাত্ দেখা দিয়েছে। আমরা যত দূর পারছি আসনের বাইরেও কয়েকটি আন্ত নগর ট্রেন ছাড়া সব ট্রেনে দাঁড়িয়েও যাত্রীদের পরিবহন করতে তাত্ক্ষণিক স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদে গতানুগতিক যাত্রী পরিবহনের প্রস্তুতি নিয়েছে রেলওয়ে। এবার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। বিশেষভাবে ইঞ্জিন যাতে বিকল না হয় তার জন্য কঠোর তদারকি দরকার।
তিন গুণ বেশি যাত্রী, সতর্কতা বাড়াতে হবে : বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দিল্লি ও মুম্বাইয়ের মধ্যে প্রতিদিন ৩৪টি এক্সপ্রেস ট্রেন চলে। আমাদের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটে দিনে চলে সব মিলিয়ে ১২টি ট্রেন। এর মধ্যে মানসম্মত আটটি। যাত্রীর চাহিদা অনুসারে ট্রেন বাড়ানো হয়নি, বগি বাড়ানো হয়নি। অথচ ঈদে যাত্রী বেড়ে হয়েছে তিন গুণ। সড়কের চেয়ে রেলপথে দুর্ঘটনার হার প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ হলেও যদি ঈদ যাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে ক্ষতি হবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি। কারণ যাত্রী বেশি বহন করা হচ্ছে। এখন বেশি সতর্ক থাকতে হবে ট্রেন পরিচালনায়, ছাদে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে হবে। রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্টদের নজরদারি জরুরি। গাফিলতিতে বড় বিপদ হতে পারে।’
ওপরের কর্তাদের তদারকি বাড়াতে হবে : বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের সামর্থ্য সীমিত, এই সামর্থ্য বাড়াতে হবে। তবে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে এখন তদারকি বাড়াতে হবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনে। জরুরি টিকিট বিক্রি করা যায়। কোনো ট্রেন পথে দেরি করলে ওয়াশফিটে নিয়ে পরিষ্কার না করে দ্রুত পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে যাত্রীদের নিয়ে আবার পরিচালনার দিকে বেশি নজর দিতে হবে। সময়সূচি যাতে ভেঙে না পড়ে তার জন্য ওপরের কর্মকর্তাদের তদারকি থাকতে হবে।’
রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন : বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে, আগামীকাল শনিবার থেকে বিশেষ ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হবে। ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা রুটে বিশেষ ট্রেন চলবে ১৮ থেকে ২১ আগস্ট। একইভাবে চলবে চাঁদপুর বিশেষ-১ ও চাঁদপুর বিশেষ-২ ট্রেন চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে। রাজশাহী বিশেষ ট্রেন রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলবে ১৮ থেকে ২০ আগস্ট। দিনাজপুর বিশেষ ট্রেন দিনাজপুর-ঢাকা-দিনাজপুর রুটে চলবে ১৮ থেকে ২০ আগস্ট। লালমনি বিশেষ ট্রেন চলবে ১৮ থেকে ২১ আগস্ট। খুলনা এক্সপ্রেস খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে চলবে ঈদের আগের দিন। ঈদের দিন চলবে শোলাকিয়া বিশেষ ট্রেন ভৈরববাজার-কিশোরগঞ্জ-ভৈরববাজার রুটে এবং শোলাকিয়া বিশেষ ট্রেন-২ চলবে ঈদের দিন ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে।

দেখা যাচ্ছে, ঢাকা থেকে সিলেটসহ বেশির ভাগ রুটে বিশেষ ট্রেন নেই।
বিশেষ উদ্যোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক গতকাল বিকেলে বলেন, ‘যাত্রীরা যখন ট্রেনের টিকিটের জন্য স্টেশনে ঘোরে, দেখতে আমারও ভালো লাগে না। পূর্ব ও পশ্চিম রেলে প্রায় ৩৫০টি ট্রেন চলছে। আপত্কালীন সংরক্ষণ করে রাখি এমন সব বগি, এসি কোচ এবার যাত্রীসেবায় দিয়ে দেব। ঢাকা-দিনাজপুর রুটে দ্রুতযানে চাহিদা বেশি থাকায় আমি একটি এসি বগি লাগাতে বলেছি। একই অবস্থা ঢাকা-সিরাজগঞ্জ রুটের সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে। এই ট্রেনে অতিরিক্ত বগি লাগানো হবে। ঢাকা-জামালপুর রুটে, উত্তরের বিভিন্ন রুটে যাত্রীর চাপ সবচেয়ে বেশি। নতুন বগি আমদানি করা হচ্ছে। এগুলো এলে ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত বগি যোগ করা হবে। এবার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লালমনি ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনেও অতিরিক্ত বগি লাগানো হবে। আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে বেশি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
কর্মকর্তারা জানান, ঈদ যাত্রা উপলক্ষে আন্ত নগর ট্রেনের সাপ্তাহিক বিরতি ১৮ আগস্ট থেকে প্রত্যাহার হচ্ছে। ঈদের তিন দিন আগে থেকে কনটেইনার ও জ্বালানি তেলবাহী ট্রেন ছাড়া পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হবে। গত ঈদের সময়ও এমনটি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ রেলওয়ের দেওয়া তথ্য মতে, ট্রেনের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ৮৫ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই ট্রেন পরিচালনা করতে হচ্ছে। একটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ২০ বছর হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়েতে ৮৫ শতাংশ ইঞ্জিনের বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে। দুই রেল অঞ্চলে ২৭২টি ইঞ্জিন আছে, তার মধ্যে ১৫ শতাংশের মেয়াদ রয়েছে। পুরনো ট্রেনে নতুন কোচ সংযোজন করা হলেও চলতে চলতে ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত একটি ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। তাতে কোনো রুটের বিভিন্ন ট্রেনের সময়সূচিও ভেঙে পড়ে। পূর্বাঞ্চল রেলে দিনে স্বাভাবিক সময়ে ২৩ জোড়া আন্ত নগর ট্রেন চলাচল করে থাকে। লোকাল ও মেইল ট্রেন চলাচল করে ২৪টি। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই এ অঞ্চলে ২০৩ বার ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচল ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। পশ্চিমাঞ্চল রেলে ১২২টি ইঞ্জিনের মধ্যে পূর্ণসক্ষম ১৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ১৫৪ বার ইঞ্জিন বিকল হয়েছে এ রেল অঞ্চলে।

ঢাকা থেকে ঈদ যাত্রার ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি ৮ আগস্ট শুরু হয়ে ১২ আগস্ট পর্যন্ত চলেছে। কমলাপুর থেকে প্রতিদিন আন্ত নগর ট্রেনের প্রায় ২৬ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। তবে টিকিট পায়নি প্রত্যাশী মানুষে বড় অংশই। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য ঈদের আগের যেকোনো দিনের যেকোনো ট্রেনের দুটি টিকিট কিনতে যান খালেদ আহমদ। নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে বলা হয় বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা বা রেলস্টেশন ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। তিনি যোগাযোগ করতে চাইলে দেখেন, ভিআইপিদের তদবির সামলাতেই ব্যস্ত রয়েছেন দুই কর্মকর্তা

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/08/17/670609