পাটুরিয়া ঘাটে গতকাল ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বাস-ট্রাকের দীর্ঘ সারি। ছবি : কালের কণ্ঠ
১৫ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:২৭

ফেরি সার্ভিসে অচলাবস্থা, ঈদে দুর্ভোগের শঙ্কা

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটা স্থবির করে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ দুটি নৌ রুট। যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন পারাপারে ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌপথে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পদ্মা নদীতে নাব্যতা সংকট। ফলে বড় ফেরিগুলো চলাচল করতে পারছে না। আর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে প্রবল স্রোতের কারণে ফেরিগুলোকে চলাচল করতে হচ্ছে নির্দিষ্ট চ্যানেল ছেড়ে অনেকটা ঘুরে। ফলে সময় বেশি লাগছে। এ অবস্থায় পদ্মার দুই পাশে চারটি ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের সারি ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে।

কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌ রুট : শিবচরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌ রুটে ফেরি চলছে থেমে থেমে। ছোট ছোট কে-টাইপ ফেরিতে সীমিতসংখ্যক পরিবহন নিয়ে ধীরগতিতে চলায় ঘাটে অপেক্ষমাণ গাড়ির বহর ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। এ ছাড়া পদ্মার লৌহজং চ্যানেলে নাব্যতা সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় আট দিন ধরে রো রো ফেরি চলাচল বন্ধ রেখেছে বিআইডাব্লিউটিসি।

ঘাট সূত্রে জানা গেছে, কাঁঠালবাড়ি লৌহজং টার্নিং পয়েন্ট ও উজানে নদীভাঙন এবং উজান থেকে পলি মিশ্রিত পানি আসার কারণে ওই বিকল্প চ্যানেল ও চ্যানেল মুখে দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই নৌ রুটে ১৭টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও দুই শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করে। নাব্যতা সংকটের কারণে ছয়টি ডাম্প ফেরি ও তিনটি রো রো ফেরি চলাচল করতে পারছে না। বর্তমানে দুটি ভিআইপি ফেরিসহ পাঁচ-ছয়টি ফেরি কোনো মতে ধীরগতিতে চলাচল করছে।
বিকল্প চ্যানেলে আট কিলোমিটার নৌপথেই নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। গত প্রায় ১১ দিন ধরে ফেরি চলাচলে এই অচলাবস্থার কারণে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে অপেক্ষমাণ পণ্যবাহী ট্রাকের লাইন ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। কাঁঠালবাড়ি ও শিমুলিয়া ঘাটে গতকাল সন্ধ্যায় পণ্যবাহী পাঁচ শতাধিক ট্রাক পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতিদিনই সংখ্যাটা বাড়ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পবিত্র ঈদুল আজহায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
এদিকে চ্যানেলমুখে সাতটি ড্রেজার দিয়ে প্রায় এক মাস ধরে লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে বিকল্প চ্যানেল তৈরির কাজ করছে বিআইডাব্লিউটিএ। কিন্তু পদ্মায় তীব্র স্রোতের সঙ্গে পলি এসে চ্যানেলমুখ দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফেরি চলাচল করতে কমপক্ষে সাত-আট ফুট গভীরতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু চ্যানেলমুখে চার-পাঁচ ফুট গভীরতা থাকায় ছোট ছোট তিন-চারটি ফেরিতে স্বল্পসংখ্যক যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।

বিআইডাব্লিউটিসির এজিএম শাহ খালেদ নেওয়াজ জানান, শনিবার বিকেলে নাব্যতা সংকটের কারণে এই নৌ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই দিন দিবাগত মধ্যরাতে একটি বিকল্প চ্যানেলের মাধ্যমে আবারও ফেরি সার্ভিস সচল করা হয়। এক দিন যেতে না যেতেই সোমবার ভোর ৪টা থেকে লৌহজং টার্নিং পয়েন্টের মুখের বিকল্প চ্যানেলটিতে পানি না থানায় আবারও বন্ধ হয়ে যায় ফেরি সার্ভিস। আট ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সোমবার দুপুর ১২টা থেকে লৌহজং টার্নিং পয়েন্টের কাছে একটি ন্যাচারাল চ্যানেল দিয়ে এখন ফেরি চলাচল করছে।

শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে নিয়মিত চলাচল করে আসছিল ২১টি ফেরি। এখন চলাচল করছে ছোট আকারের মাত্র ৯টি ফেরি। এর মধ্যে ছয়টি কে-টাইপ ও তিনটি মধ্যম আকৃতির। নাব্যতা সংকটের কারণে এগুলোতেও আবার পূর্ণ লোড দেওয়া যাচ্ছে না। এতে ঘাটে আটকা পড়েছে পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। বিআইডাব্লিউটিসি পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে এই নৌ রুট পরিহার করে বিকল্প পথে যাতায়াতের পরামর্শ দিয়েছে।

বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পদ্মায় এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে। এর ওপর কারো হাত নেই। তবে আমরা পুরোপুরি ফেরি সচল রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছি। ঈদে যাতে রো রো ফেরিসহ সব ফেরি সচল রাখা যায় সে জন্য পদ্মা সেতুর কাজে ব্যবহৃত চ্যানেলের একটি অংশ দিয়ে ফেরি চলাচলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতিও পাওয়া গেছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান চ্যানেলটি ঈদ পর্যন্ত ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।’
কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব বেপারী বলেন, ড্রেজিংয়ের নামে বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না। কেবল নানা কারণ দেখিয়ে যাচ্ছে বিআইডাব্লিউটিএ। এ অবস্থায় আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষ ঘাট দিয়ে অনায়াসে পারাপার হতে পারবে কি না তা বলা মুশকিল।
কাঁঠালবাড়ি ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন বলেন, নাব্যতা সংকটে রো রো ফেরিগুলো বন্ধ রয়েছে। তবে নৌযান চলাচলে যাতে সমস্যা না হয় সে জন্য চ্যানেলটি সচল রাখতে সাতটি ড্রেজার দিয়ে বিকল্প চ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা সভা : শিমুলিয়া ঘাট দিয়ে দক্ষিণবঙ্গগামী ঈদমুখো মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে গতকাল শিমুলিয়া ঘাটে এক সভার আয়োজন করে লৌহজং উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানার সভাপতিত্বে ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু জাফর রাশেদের সঞ্চালনায় এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম পিপিএম সড়ক ও নৌপথে চলাচলকারী যানবাহন কর্তৃপক্ষগুলোকে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দেন।
সভায় বক্তাদের অনেকে বলেন, এই নৌ রুটে নাব্যতা সংকটের জন্য বিআইডাব্লিউটিএ দায়ী। মাসাধিককাল আগে নাব্যতা সংকট দেখা দিলেও সময়মতো জরিপ ও পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ রুট : গত কয়েক দিন ধরে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি ও প্রবল স্রোত অব্যাহত থাকার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ রুটে ফেরি চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের পর পাটুরিয়া ঘাটে পণ্যবাহী আড়াই শতাধিক ট্রাকসহ সাড়ে তিন শতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে যাত্রী ও ট্রাকচালকরা।
ঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই নৌ রুটে নিয়মিত ছোট বড় ১৭টি ফেরি চলাচল করে। তবে ঈদের আগে যানবাহনের বাড়তি চাপ সামলানোর জন্য গতকাল আরো তিনটি রো রো ও একটি কে-টাইপ ফেরি এ বহরে যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে এই রুটে ফেরি সংকট না থাকলেও প্রবল স্রোতের কারণে ফেরি দু-তিন কিলোমিটার উজানে গিয়ে নদীপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে স্বাভাবিক সময়ের থেকে পারাপারে বেশি সময় লাগছে। ফলে ফেরির ট্রিপ সংখ্যা কমে গেছে।

বিআইডাব্লিটিসির আরিচা কার্যালয়ের এজিএম নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী জানান, নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে ঘাটের পন্টুন ওঠানো-নামানো এবং পদ্মায় প্রবল স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে পাটুরিয়া ঘাটে বাস-ট্রাক মিলে সাড়ে তিন শ যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাত্রীবাহী বাসগুলো আগে পার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে গমবোঝাই করে খুলনাগামী ট্রাকচালক মাসুম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোমবার রাতে পাটুরিয়া ঘাটে এসে নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় আছি। কবে কখন ফেরিতে উঠতে পারব বলতে পারছি না।’
রাজবাড়ী পরিবহনের বাসযাত্রী ফারুক গতকাল দুপুর ২টার দিকে বলেন, ‘তিন ঘণ্টা ধরে ঘাটে বসে আছি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। কিন্তু কখন যে গাড়ি ফেরিতে উঠতে পারবে সে ব্যাপারে কেউ কোনো ধারণাও দিতে পারছে না।’
এদিকে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ফেরি পারাপার ব্যাহত হওয়ায় দৌলতদিয়ায় ঢাকাগামী বিভিন্ন গাড়ির চাপ বেড়ে গেছে। এতে দৌলতদিয়া ঘাটে দীর্ঘ যানজট লেগে আছে। গতকাল দৌলতদিয়া ঘাটে আটকা পড়ে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ ঢাকাগামী শত শত গাড়ি। এর মধ্যে কোরবানির পশুবোঝাই অনেক ট্রাক রয়েছে।

বিআইডাব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঈদ সামনে রেখে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ছোট-বড় মিলে মোট ২০টি ফেরি সার্বক্ষণিক সচল রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি রো রো (বড়), তিনটি কে-টাইপ (মাঝারি) এবং আটটি ইউটিলিটি (ছোট)। এতে ব্যস্ততম এই নৌপথে ফেরি সংকট কাটলেও তীব্র স্রোতের কারণে সেগুলো নির্দিষ্ট চ্যানেল ছেড়ে দেড়-দুই কিলোমিটার ভাটিপথ ঘুরে চলাচল করছে। এতে সময় অনেক বেশি লেগে যাওয়ায় ফেরির ট্রিপসংখ্যা কমে গেছে।
গতকাল দুপুরে দৌলতদিয়া ঘাট সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ফেরি ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কের বাংলাদেশ হ্যাচারিজ এলাকা পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তার একপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে শত শত গাড়ি। কোথাও কোথাও তিন-চার সারি করে গাড়ি রাখায় সড়কে তীব্র যানজট লেগে আছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/08/15/669904