৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:৪২

কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্পে হরিলুট: ৮ কোটি টাকার হদিস নেই ; দু’দফা সময় বাড়িয়েও অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি ; ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ

কারিগরি শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ডিটেইল প্রজেক্ট পরিকল্পনা (ডিপিপি) অনুযায়ী খাতভিত্তিক বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা হয়নি। যে খাতে অর্থ কম ছিল, তাতে যন্ত্রপাতি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের নামে বেশি খরচ করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ খাতে বেশি বরাদ্দ থাকলেও খরচ করা হয়েছে কম। প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যাপক শিথিলতা ছিল। যে কারণে দু’দফা সময় বাড়ানো হয়, তা সত্ত্বেও প্রকল্পের সব অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় প্রকল্প ব্যয় ৬৫ শতাংশ কমানো হয়। তারপরও লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এখানেই শেষ নয়, দেড় বছর আগে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হলেও অব্যয়িত ৮ কোটি টাকা এখনও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি। এভাবে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা এবং কোটি কোটি টাকা লুটপাটের কারণে প্রকল্পের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় এক মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণ, কেনাকাটায় অনিয়ম ও অব্যয়িত অর্থের হদিস জানাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদনে (পিসিআর) এসব তথ্য উঠে এসেছে।


এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘৮ কোটি টাকার বিষয়ে আমাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে যে, তা উন্নয়ন সহযোগীরা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিবেদন পেয়েছি। প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।’

জানতে চাইলে কারিগরি অধিদফতরের মহাপরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) অশোক কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আইএমইডির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। ঘটনা প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ জানা যায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণকে যুগোপযোগী, লাগসই ও অধিক শিল্প-সম্পর্কিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে কারিগরি অধিদফতর। সুইডিস ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের অনুদান, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তা ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ প্রকল্পে ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে সরকারের বিনিয়োগ ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময় প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ১৬২ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৫৪ কোট ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অব্যয়িত ৮ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার নিয়ম থাকলেও পিসিআর কমিটি কোনো হদিস পায়নি।

প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশোধিত বাজেটের মোট অর্থের ৯৫ শতাংশ শেষ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়। তবে পিসিআর কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাস্তব (প্রথম বাজেটের) অগ্রগতি ৩০ দশমিক ৮৫ ভাগ। সবচেয়ে দুর্নীতি হয়েছে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। এ খাতে ডিপিপি অনুযায়ী ২২ কোটি ৬২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বরাদ্দের ৯২ ভাগ খরচ দেখানো হয়েছে। ৩ হাজার ৯৩৩টি সেট যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কথা থাকলেও ক্রয় করা হয়েছে ৭ হাজার ৯৫৮ সেট। ব্যয়ের হিসাবে শতকরা হার ২৩২ ভাগ। নির্মাণকাজে ৬৩ কোটি ৩৪ লাখ ২ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বরাদ্দের শতকরা ৯২ দশমিক ২৭ ভাগ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে ১১ হাজার ৬৫ বর্গমিটার অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৮৬৯ বর্গ মিটার। শতকরা হিসাবে ব্যয়ের হার ১৮৮ ভাগ। দুর্নীতির জন্যই এ বাড়তি নির্মাণকাজ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আসবাবপত্র ক্রয়ে ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিবেদনে সুুপারিশ করা হয়েছে।

ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্পের জনবল খাতে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা খরচ করা করেছে। শতকরা হিসাবে ১০৫ দশমিক ৪১ ভাগ দেখানো হয়েছে। বাস্তবে ১৯২০ জনের বিপরীতে কাজ করেছে ১৫৯৬ জন। এ খাতে কাজ হয়েছে ৮৩ দশমিক ১২ ভাগ। মার্কেটিং ও প্রচার খাতে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৫ হাজার। খণ্ডকালীন শিক্ষকের জন্য ৭ কোটি ১৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ৩ হাজার ৮৪০ জন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৪০ জন। অর্থাৎ এ খাতে ৯৩ ভাগ কাজ হয়েছে। এ হিসাবে বরাদ্দে ৭ শতাংশ অর্থ দুর্নীতি হয়েছে।

স্টাফ উন্নয়ন খাতে ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে খরচ হয়েছে ৩৩ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ খাতে ৯৯ ভাগ অর্থ খরচের দাবি করা হলেও বাস্তবে খরচ হয়েছে ৯৩ দশমিক ৩১ ভাগ। কারণ ২৯ হাজার ৮৯৫ জনকে প্রশিক্ষণের দাবি করা হলেও ২৭ হাজার ৮৯৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের পরামর্শক খাতে ১৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ১৪ কোটি ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। খরচের হার ৯৯ ভাগ দেখানো হয়েছে। বাস্তবে ৩০৯ জনের বিপরীতে ২২৪ জন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দের ৭৩ ভাগ খরচ হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পে অর্থ সাহায্য কমানোর কারণে প্রকল্প ব্যয় কমেছে। ফলে প্রকল্পের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন এবং পরামর্শক নিয়োগে বিলম্বের কারণে কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়নি। বরাদ্দকৃত সব অর্থ খরচ না হওয়া এবং প্রকল্পের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার জন্য প্রকল্প কর্মকর্তাদের অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় না বাড়লেও সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্মাণকাজে বাজেটের চেয়ে আর্থিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। প্রকল্প ২০১৫ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আইএমইডিতে প্রকল্পের পিপিআর জমা দেয়ার কথা। কিন্তু ১ বছর ৪ মাস পরে জমা দেয়া হয়েছে। এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন, পিসিআর, ডিপিপি, মনিটরিং রিপোর্টসহ প্রকল্পের বিভিন্ন সভার প্রতিবেদনের আলোকে মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। গত ১২ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি হাতে পায়। সে হিসাবে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জবাব পাঠাতে হবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/06/98799/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A7%81