৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:৪১

নিয়ন্ত্রণহীন স্পিডবোট, দুই বছরে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৫ জনের

মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে স্পিডবোট চলাচলে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাড়তি ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি রাতেও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী বহন ও যাত্রী নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করছে স্পিডবোটগুলো। এতে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে যাত্রীরা।
স্পিডবোট দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও স্পিডবোট মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা নদীতে গত দুই বছরে নয়টি স্পিডবোট দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৫ জনের। সর্বশেষ দুর্ঘটনা হয়েছে গত ৬ জানুয়ারি। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় মামলা হলেও কোনোটিরই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। গ্রেপ্তারও হননি কেউ।
বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক (বন্দর) মহিউদ্দিন বলেন, রাতে বা দিনে চলাচল ও অন্যান্য বিষয় দেখার কথা নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ সচেতন না হলে এসব দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না। মানুষ রাতে না উঠলে স্পিডবোট চলবে না।
শিমুলিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক সরোজিৎ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, রাতে স্পিডবোট চলাচল বন্ধের উদ্যোগ থাকলেও জনবলের সংকটে সেটা তদারক করা হয়ে ওঠে না।
আগে নৌপথ ছিল মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে মাদারীপুরের শিবচরের কাওড়াকান্দি। কাওড়াকান্দি থেকে গত ১৫ জানুয়ারি ঘাট কাঁঠালবাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ও শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি পথে ২৪০টি স্পিডবোটের নিবন্ধন রয়েছে। পরে কয়েকটি স্পিডবোট নবায়ন করেনি। তবে চলছে ৪৫০টি স্পিডবোট। তিনি বলেন, বড় একটি স্পিডবোটে যাত্রী ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৪ জন। ছোটগুলোতে ৮-১০ জন।
কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি কাঁঠালবাড়ি ও শিমুলিয়া ঘুরে দেখা যায়, একেকটি বড় স্পিডবোটে ২৪ থেকে ২৮ জন যাত্রী তোলা হচ্ছে। যাত্রীদের চাপাচাপি করে বসানো হচ্ছে। কোনো যাত্রী আপত্তি করলে চালক ও মালিকপক্ষের লোকজন তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। নিয়ম থাকলেও কোনো যাত্রীকে লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়নি। স্পিডবোটের সঙ্গে বয়াও নেই। অথচ জনপ্রতি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সূত্রমতে, এই পথে ভাড়া হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৮০ টাকা।
কাঁঠালবাড়ি থেকে শিমুলিয়াগামী যাত্রী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আশিষ শিকদার বলেন, জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে তিনি স্পিডবোটে উঠেছেন। এখানকার চালকদের আচরণ খুব রূঢ়। লাইফ জ্যাকেট ঘাটে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাত্রীদের দেওয়া হয় না। এসব বিষয়ে কথা বললে স্পিডবোট থেকে নেমে যেতে বলেন চালক ও মালিকপক্ষের লোকজন। শিমুলিয়া থেকে কাঁঠালবাড়িগামী যাত্রী ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার বিজয় দাস বলেন, দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও সময় বাঁচানোর জন্য তিনি সব সময় স্পিডবোটেই চলাচল করেন।
শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাটের ইজারাদার, মেদেনীদণ্ডল ইউপির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন খান বলেন, সন্ধ্যা হলেই ঘাট বন্ধ করা হয়। কিন্তু মানুষের তদবিরের কারণে কখনো কখনো রাতেও দু-একটি স্পিডবোট চলে। তিনি দাবি করেন, স্পিডবোট চলাচলে অনেকটাই শৃঙ্খলা এসেছে। আগের চেয়ে এখনকার স্পিডবোটের ক্ষমতা বেশি, তাই বেশি লোক নেওয়া হয়। ধারণক্ষমতা বাড়াতে বিআইডব্লিউটিএতে আবেদন করা হয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা হয়।
শিবচরের পাচ্চর ইউপির চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও কাঁঠালবাড়ি ঘাটের স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, যাত্রীদের চাপে মাঝে মাঝে কিছু চালক হয়তো রাতে স্পিডবোট চালান। লাইফ জ্যাকেট যাত্রীরা নিতে চান না। তবে বর্ষাকালে সবাইকে পরতে বাধ্য করা হয়।
যাত্রী ও বিআইডব্লিউটিএর সূত্র বলেছে, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও রাতে ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় স্পিডবোট চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণ অদক্ষ চালক।
সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি দুই স্পিডবোটের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান ঢাকা জেলা পুলিশের কনস্টেবল হায়দার হোসেনের স্ত্রী হোসনে আরা লিপিসহ তিনজন। গুরুতর আহত হন লিপির ভাই রুবেল। রুবেলকে সৌদি আরবের উদ্দেশে বিমানে তুলে দিতে শিশুসন্তানসহ লিপি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার বালিয়াচরা গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন। ঘন কুয়াশার কারণে সেদিন পদ্মা নদীতে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতেও স্পিডবোট চলেছে।
লিপির স্বামী হায়দার হোসেন বলেন, ‘স্ত্রীকে হারিয়ে দুটি শিশুসন্তান নিয়ে আমি অথৈ সাগরে পড়েছি। শ্যালক হাসপাতালে ছটফট করছেন। এ ঘটনায় মামলা হলেও অদক্ষÿচালকদের আসামি করা হয়নি।’
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। ওই দুটি স্পিডবোটের চালকদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। আর লৌহজং থানার ওসি আনিচুর রহমান বলেন, স্পিডবোট চলাচলে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় লঞ্চের পেছনে থেকে স্পিডবোটের চালকেরা যাত্রী নেন। ঘাট বন্ধ থাকলে মানুষ চরে গিয়েও স্পিডবোটে ওঠেন।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনির হোসেন বলেন, রাতে স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হয়। জরিমানা আদায়, এমনকি স্পিডবোট জব্দও করা হয়। তারপরও প্রশাসনের নজর ফাঁকি দিয়ে চলে। এ বিষয়ে যাত্রী ও চালকদের সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শিবচরের ইউএনও ইমরান আহমেদ বলেন, সন্ধ্যার পর চলাচল নিয়ন্ত্রণে ঘাটে পুলিশ দেওয়া হয়েছে।
শিবচর থানার ওসি জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, পুলিশ ঘাটে দায়িত্ব পালন করে। ঘাট থেকে রাতে স্পিডবোট চলে না। গত এক বছরে এই থানায় স্পিডবোট দুর্ঘটনার তিনটি মামলা হয়েছে। একটিরও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। কেউ গ্রেপ্তারও হননি।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1075359/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%A1%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%9F-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3