১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৮

আবার বন্ধের শঙ্কায় মালয়েশিয়ার দরজা

 

সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি প্লাস) মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই বন্ধের উপক্রম হয়েছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সে দেশের কর্মী নিয়োগকারী সংস্থা ফেলডা গ্গ্নোবাল ভেঞ্চার (এফজিভি) মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিয়ে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে বলেছে। মূলত রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর দ্বন্দ্বের কারণেই এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (কেডিএন) চাহিদাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি রিত্রুক্রটিং এজেন্সির মাধ্যমে পাঁচ হাজার ২৪০ কর্র্মী নিয়োগের অনুমোদন দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সপ্তাহ না ঘুরতেই এফজিভির প্রেসিডেন্ট দাতো জাকারিয়া আশরাফ চিঠিতে জানান, এরই মধ্যে সাতটি রিত্রুক্রটিং এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ যে পাঁচ এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছে, তা এফজিভির স্বীকৃত চাহিদাপত্র নয়। এর ফলে বহুল আলোচিত জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, জিটুজি প্লাসের মাধ্যমে বনায়ন খাতে পাঁচ হাজার এবং শিল্পকারখানার জন্য ২৪০ কর্মীর চাহিদাপত্র পাঠায় কেডিএন। যেসব এজেন্সির মাধ্যমে এই চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে সেগুলো হলো_ আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইউনিক ইস্টার্ন লিমিটেড, আল ইসলাম ওভারসিস, প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ও ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল।

বঞ্চিত রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, ১০টি প্রতিষ্ঠানের গড়া 'সিন্ডিকেট' নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এফজিভির অনুমোদন না নিয়েই অবৈধভাবে কেডিএন ও সিনারফ্ল্যাক্সের মাধ্যমে চাহিদাপত্র এনেছে। বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সিনারফ্ল্যাক্স মালয়েশিয়ায় ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডবি্লওসিএমএস)

ব্যবস্থাপনায় কাজ পেয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ হবে। এদিকে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশি

রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামকে

পাঠানো এভজিভির চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা সাতটি এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের জন্য নিযুক্ত করেছে। এগুলো হলো_ সরকার রিত্রুক্রটিং এজেন্সি লিমিটেড, এলিগেইন্স ওভারসিস লিমিটেড, আরিজ এন্টারপ্রাইজ, ইমন এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস,

কিউপিড ট্রেডস, আল-দোশারি এন্টারপ্রাইজ ও এমএম কনসালট্যান্টস।

এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি দূতাবাস থেকে এফজিভিকে দেওয়া চিঠিতে জানানো হয়েছিল, পাঁচ এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। কেডিএন এরই মধ্যে তাদের চাহিদাপত্র দিয়েছে। এর তিন দিন পর ফিরতি চিঠিতে এফজিভি প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূতকে জানান, তারা কেডিএনের সঙ্গে কথা বলেছে। একমাত্র এফজিভির প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। তারা কেডিএনকে এমন কোনো অনুমোদন দেয়নি।

চিঠির বিষয়ে জানতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলামের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অনেকবার ফোন ও ই-মেইলে বার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি। মন্ত্রী ও সচিবের কাছে চিঠির অনুলিপি পেঁৗছলেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ সমকালকে বলেন, 'চিঠির বিষয়ে আমাদের জানা নেই।'

রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব এবং কর্মী প্রেরণের 'কাজ পাওয়া' প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপন চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে তার অভিযোগ, যেসব এজেন্সি কাজ পায়নি তারাই এফজিভিকে ভুল বুঝিয়ে এ চিঠি পাঠিয়েছে।

এদিকে বঞ্চিত এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাঁচ এজেন্সি কাজ পেয়েছে। এতে করে প্রতিযোগিতা থাকবে না। এজেন্সিগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করবে। তারা আরও অভিযোগ করেন, এর ফলে কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যেতে সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৩৭ হাজার টাকার কয়েকগুণ খরচ হবে। এরই মধ্যে এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

তবে বায়রার মহাসচিব রহুল আমিন স্বপন পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, 'এফজিভি যে সাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে চিঠি দিয়েছে তারাই প্রকৃত সিন্ডিকেট। তারা কর্মী পাঠানোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছে।' সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কর্মীরা সরাসরি এজেন্সির কাছে আসেন না। দুই-তিন হাত ঘুরে আসেন। এতে কিছুটা ব্যয় বাড়ে। তবে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা করে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বানোয়াট।'

তবে দু'পক্ষই স্বীকার করেছে এফজিভির চিঠির কারণে কর্মী প্রেরণ বিলম্বিত হয়েছে। বায়রার সাবেক মহাসচিব আবুল কালাম মনসুর বলেন, এ মুহূর্তে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ নেই। এফজিভি যেখানে বলে দিয়েছে চাহিদাপত্রের বৈধতা নেই, সেক্ষেত্রে গত মাসে সোয়া হাজার কর্মীর চাহিদাপত্র আর কার্যকর নয়। তবে রুহুল আমিন স্বপনের দাবি, কিছুটা বিলম্ব হলেও চাহিদাপত্র বাতিল হবে না। এ সমস্যা কিছু দিনের মধ্যেই কেটে যাবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যে পাঁচ এজেন্সি কাজ পেয়েছে তারা কর্মীর তালিকা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) দেবে। অনলাইনে যাচাই-বাছাই হবে। কিন্তু তার আগেই এফজিভির চিঠিতে সৃষ্টি হলো অনিশ্চয়তা।

নানা অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী পাঠাতে ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ কর্মী নেওয়ার আশ্বাস দেয় মালয়েশীয় সরকার; কিন্তু আড়াই বছরে মাত্র আট হাজার কর্মী যায়। এতে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার ভয়াবহ পর্যায়ে পেঁৗছায়। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডে ও মালয়েশিয়ায় পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের গণকবর আবিষ্কৃত হলে সারাবিশ্বের সমালোচনার ঝড় ওঠে। আবারও কর্মী নিতে প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া।

গত বছরের ১৮ দুই দেশের জিটুজি প্লাস সমঝোতা স্মারক সই হয়। তবে এর পরের দিনই মালয়েশিয়া বলে, আপাতত তারা কর্মী নেবে না। গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ান মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে ২০১৫ সাল থেকেই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে লড়াই চলছে। উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এ লড়াই। বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাসারের নেতৃত্বে একপক্ষ এবং রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ১০ এজেন্সি কাজ পেতে চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন ১০ এজেন্সি কাজ পেলেও এফজিভির চিঠিতে আবারও মালয়েশিয়ার দুয়ার বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
- See more at: http://bangla.samakal.net/2017/02/17/270795#sthash.wvNBbNuv.dpuf