১৯ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩১

যেখানে অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

ন্যায়ের বিপরীত শব্দ অন্যায়। নীতিনৈতিকতাবিরোধী, শিষ্টাচার ও মূলবোধ বিবর্জিত, ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ এবং দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী যেকোনো কাজ অন্যায়। সমাজ ও দেশের আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অবস্থান সব সময় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে হয়ে থাকে। এরূপ ব্যক্তিরা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। বর্তমানে আমাদের দেশ ও সমাজে অন্যায় এমনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে যে, আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণে সাহসী হয়ে ওঠেন না। অন্যায়ের প্রতি সরাসরি ও মৌন সমর্থনও অন্যায়। নীতিনৈতিকতা ও বিবেকের তাড়নায় একজন আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া দায়িত্ব হলেও বর্তমানে এ দায়িত্ব পালনে অনেকেই সচেষ্ট নন।

আমাদের দেশের জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম ন্যায়কে ধারণ এবং অন্যায়কে বর্জনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর জন্য অন্যায়কে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা অপরিহার্য। আর কারো যদি শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার সাহস বা সামর্থ্য না থাকে সে ক্ষেত্রে তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদে অক্ষম এমন ব্যক্তিদের অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেই তুষ্ট থাকতে হয়। অন্যায় বিষয়ে যাদের শেষোক্ত অবস্থান ইসলামের দৃষ্টিতে তারা দুর্বল ঈমানের অধিকারী। ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা।

ইসলামি ও মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সর্বোচ্চ আইন হলো কুরআন, অপর দিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সর্বোচ্চ আইন হলো সে দেশের সংবিধান। আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এবং আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও আমরা সাংবিধানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্র নই। আর এ কারণে হত্যা, ধর্ষণ ও চুরির মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কুরআন নির্দেশিত শাস্তির সাথে আমাদের প্রচলিত দণ্ড আইনে উল্লিখিত শাস্তির পার্থক্য রয়েছে।

ইসলাম অপর ধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার অনুমোদন দেয় না। কোনো ইসলাম ধর্মাবলম্বী যদি এ কাজ করে সে ক্ষেত্রে এটি তার জন্য অন্যায়। পৃথিবীর যেসব দেশ ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ করে সেসব দেশে একজন নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশে কোনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দিয়ে তাদের ধর্মীয় বিধান পালনে বাধার মুখোমুখি হওয়া যেমন অন্যায় অনুরূপ তাদের কাউকে জোরপূর্বক ইসলামের বিধান অনুসরণে বাধ্য করাও অন্যায়। আমাদের দেশে অপর কোনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তিনি রাষ্ট্রের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারেন। আমাদের পাশের দেশ ভারত হিন্দু অধ্যুষিত। ভারতে উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেখানকার বিভিন্ন রাজ্যে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের তাদের ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধার মুখোমুখি হওয়া এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেলেও ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিকার প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করার মতো অনুকূল পরিবেশ ছিল না অথবা প্রতিবাদ-পরবর্তী অনেককে নিঃগৃহীত ও হেনস্তার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সুতরাং অন্যায়ের প্রতিবাদ নাগরিক কর্তব্য হলেও তা প্রয়োগের জন্য চাই অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ।
আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে উল্লেখ রয়েছেÑ সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধান আমাদের নাগরিকদের শর্তসাপেক্ষে সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতা দিয়েছে; কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা এবং সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যায়ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত পুলিশ কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অপর দিকে সমরূপ কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে সরকারি দল বা এর অঙ্গসংগঠন বা এর জোটভুক্ত অপর কোনো দল বা তাদের অঙ্গসংগঠন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ কেউ নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন আবার কেউ কেউ অন্যায়ভাবে কারান্তরীণ হচ্ছেন। আবার অনেকে প্রতিবাদ না করেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মে যারা নিয়োজিত তাদের বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদি জনগণ দেয় করের অর্থ দিয়ে নির্বাহ করা হয়। এদের সবার আবশ্যিক কর্তব্য জনগণকে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়া। সর্বশেষ অষ্টম বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের যে হারে বেতন, ভাতা ও অপরাপর সুযোগ-সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে, এদের কারো বেতনবহির্ভূত অন্যায় বা অবৈধ পাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা নয়; কিন্তু বাস্তবতা হলো এদের খুব কমসংখ্যক এ পথ থেকে বিরত। সর্বশেষ বেতন স্কেল বাস্তবায়ন-পরবর্তী অন্যায় তথা দুর্নীতিবিষয়ক অবস্থানের উত্তরণ না হওয়ায় রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে আসীন অনেককে আক্ষেপ করতে দেখা গেলেও এর প্রতিবিধানে তাদের পক্ষ থেকে কার্যকর বা ফলপ্রসূ ব্যবস্থা না নেয়ায় দেশবাসী আশাহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্তভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ তার জন্য বিপর্যয়ের বার্তাবহ হলেও সমষ্টিগত প্রতিবাদ-প্রতিকারে সহায়ক মনে করা হলেও কায়েমি স্বার্থবাদীদের কারণে তা বাস্তবায়ন বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার কারণে এর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়।

পৃথিবীর সব দেশেই বিচার বিভাগকে বলা হয় জনগণের শেষ ভরসাস্থল। পৃথিবীর সর্বত্র বিচার বিভাগ জনমানুষের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে কিছু বিচারকের আচরণের কারণে এটি জনমানুষের অধিকার হরণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলেও এ ধরনের বিচারক দিয়ে যারা অন্যায়ের শিকার হয়েছেন এরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য ভোগের কারণে ভুক্তভোগীদের এদের বিরুদ্ধে প্রতিকারহীন অবস্থায় আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ চাকরিজীবীদের চেয়ে অধিক বয়সে অবসরের সুবিধা ভোগ করায় দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন অনেকে অন্যায়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বর্ধিত বয়স পর্যন্ত চাকরির সুযোগ নিয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ সচিব পদে আসীন এমন কয়েকজনের সন্ধান পাওয়া গেলেও আজ অবধি তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা রুজু করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা অগণিত। কিন্তু যারা তালিকা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এদের অনেকে অন্যায় প্রাপ্তি দিয়ে বশীভূত হয়ে এ কাজ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারছেন না।

দেশের জনমানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে জনসমর্থন রয়েছে এমন রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশে অতীতে কখনো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না এ বিষয়ে আমাদের দেশের বড় দু’টি দলের অবস্থান ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এবং ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় এক ও অভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে দেশে কখনো গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। আর গণতন্ত্র বিকশিত না হলে তা অন্যায়ের বিস্তৃতির পথ প্রশস্ত করে। যেকোনো পক্ষপাতদুষ্ট ও কলুষতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্যায় সুযোগ দিতে হয়। যেকোনো সরকারের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ ধরনের অন্যায় সুযোগ প্রদান-পরবর্তী তাদের কাছ থেকে ন্যায়ের প্রত্যাশী হওয়া দুরাশা বৈ আর কিছু নয়। আর এ কারণেই দেখা যায় অবৈধ ও অন্যায়ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে যারা ক্ষমতাসীন হয় তাদের পক্ষে কখনো সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেকোনো দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে তা দেশের জনমানুষের এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য চাই আইনের শাসন। আইনের শাসনের নিশ্চিতের পূর্বশর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল। রাষ্ট্রক্ষমতায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনমতের প্রতিফলনে যারা অধিষ্ঠিত হন তাদের পক্ষে সুশাসন নিশ্চিত করা সহজ। সুশাসন নাগরিকদের জন্য যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবিধান ও প্রতিবাদ নিশ্চিত করলেও দুঃশাসন যে এর বিপরীত তা সময় ও কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/326006