১৪ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৯

প্রচণ্ড গরম আর যানজটের ভোগান্তি নিয়ে ছুটছে মানুষ নাড়ির টানে

মনে ঈদের আনন্দ। আর যাত্রাপথে জীবনের ঝুঁকি তবুও যেতে হবে বাড়ি নাড়ির টানে। ছবিটি গতকাল বুধবার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তোলা -সংগ্রাম
গতকাল বুধবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে ঘরমুখো মানুষের নাড়ির টানে বাড়িযাত্রা। দুপুরের পর থেকে আরও বাড়তে থাকে রেল স্টেশন লঞ্চঘাট বাস টার্মিনালে মানুষের চাপ। রাজধানীর বাস ও রেল স্টেশনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লেগে যায়। আনন্দের এই যাত্রার সঙ্গে শুরুতেই সঙ্গী হয়েছে প্রচণ্ড গরম আর ভোগান্তির যানজট। ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় মানুষের এই ভোগান্তি। আজ বৃহস্পতিবার শেষ অফিস, এরপর শুরু হচ্ছে ঈদের ছুটি। তবে গতকাল বুধবার একদিনের জন্য শবে কদর উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ছিল। এই সুযোগে অনেক সরকারি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী গতকালকেই ছুটেছেন বাড়ির দিকে। যে কারণে দুপুর হতেই বাস টার্মিনাল ও স্টেশনগুলোতে ভিড় লেগে যায় ঘরমুখো মানুষের। রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, গুলিস্তান বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে খবর নিয়ে জানা গেছে দুপুরের দিকেই মানুষের ঢল নেমেছে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

টার্মিনালে উপচে পড়ছে মানুষ। কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় হাজার হাজার ঘরমুখো মানুষ ভিড় জমিয়েছে। গত ৩ জুন থেকে যারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেছিলেন তারাই আজ কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে ঢাকা ছাড়ছেন। অগ্রীম টিকিট বিক্রি অনুযায়ী গত ১০ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে ঈদযাত্রা, সেই হিসেবে আজ পঞ্চমদিনের মতো কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনযোগে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। বিগত দিনগুলোর তুলনায় আজ কমলাপুরে ঈদ উদযাপনে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের ভিড় ছিল কিছুটা বেশি। তবে স্টেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ৩ দিন ঘরে ফেরা মানুষের সবচেয়ে বেশি ভিড় হবে। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল বুধবার সকাল থেকেই তীব্র যানজট। এ দুটি মহাসড়কে যান চলাচল খুবই ধীরগতির ছিল। দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে ভুলতা ফ্লাইওভার নির্মাণ, কাঁচপুর সেতু ও মেঘনা সেতুতে সকালে কয়েকটি যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে যানজট প্রকট আকারে রূপ নেয়।
রেলযাত্রা: গত মঙ্গলবার থেকে মোট ৬৬টি ট্রেন কমলাপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশে ছেড়েছে। কমলাপুর স্টেশনের প্লাটফর্মে সকাল থেকেই কাঙ্কিত ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় ছিল সাধারণ যাত্রীরা। তাদের প্রায় সবার হাতেই ব্যাগ-লাগেজ।
সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে ৭ নম্বর কাউন্টারে এসে পৌঁছালো দিনাজপুর থেকে ছেড়ে আসা একতা এক্সপ্রেস। কমলাপুর থেকে আবার কিছুক্ষণ পরই অর্থাৎ ১০টায় দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে ট্রেনটি। আগে থেকেই প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় ছিলেন হাজারো মানুষ। ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানো মাত্রই যাত্রীদের হুড়োহুড়ি। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে উঠছে সবাই। টিকিট সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত যেন ভোগান্তি-বিড়ম্বনার শেষ নেই তবুও ঈদে আসলেই প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য, আর নাড়ির টানে ঘুরমুখো মানুষের ছুটে চলা যেন এটাই রীতি।

৯টা ১৫ মিনিটে ৩ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে যায় উত্তরবঙ্গগামী রংপুর এক্সপ্রেস। সেখানেও ছিল ব্যাপক যাত্রীর উপস্থিতি। ঈদ উদযাপনে সবাই যেন ছুটছে। সেই ট্রেনের জন্যই আগে থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রায় ১১ ঘণ্টা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে আজকের টিকিট পেয়েছিলাম, আবার ট্রেনে হুড়োহুড়ি করে উঠতে হবে, মানুষের ভিড়ে টিকিট অনুযায়ী আসনের কাছে পৌঁছানোই কঠিন। ঈদ আসলে টিকিট সংগ্রহ থেকে বাড়ি ফেরা আবার ফিরে আসা পর্যন্ত পদে পদে বিড়ম্বনা-ভোগান্তি। তবুও মানুষ সেসব উপেক্ষা করে নিজ গ্রামে ছুটে যায়। আর এত ভোগান্তি উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে প্রিয়জনের মুখ দেখলেই সব ভোগান্তি ভুলে যায় সবাই। এদিকে যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার সুন্দরবন এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ও দিনাজপুর এক্সপ্রেস কিছুটা দেরি করে ছেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতিদন কমলাপুর থেকে প্রায় ৬০/৭০ হাজার মানুষ বিভিন্ন প্রান্তে যাবেন। যাত্রী চাপ সামলাতে প্রায় প্রতিটি ট্রেনেই অতিরিক্ত বগি লাগানো হয়েছে। এছাড়া যাত্রীদের সুবিধার্থে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। তিনি যাত্রীদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, নিজেদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কোনো অবস্থাতেই যেন যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ না করেন।
বাসযাত্রা: পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ করতে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে আসেন চাকরিজীবী আব্দুর রহমান। ইকোনো পরিবহনের কাউন্টারে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। মি. রহমান যাবেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। তিনি জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় এসেছি এখন প্রায় ২টা বাজে। বাস আসার কোন খবর নেই। কাউন্টার থেকে বার বার বলে দিচ্ছে রাস্তায় যানজট তাই বাস আসতে দেরি হচ্ছে। পরিবার পরিবজন নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই ইউনুস সাহেবের।
ইকোনো বাস কাউন্টারের ম্যানেজার তোফায়েল হোসেন জানান, রাস্তায় ব্যাপক যানজট। রায়পুর থেকে বাস আগে ৫ ঘণ্টায় ঢাকা আসতো। এখন ১১ ঘণ্টায়ও বাস আসতে পারে না যানজটের কারণে। এর ফলে ঈদে ঘরমুখী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তীব্র যানজট। এ দুটি মহাসড়কে যান চলাচল খুবই ধীরগতির ছিল। দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে ভুলতা ফ্লাইওভার নির্মাণ, কাঁচপুর সেতু ও মেঘনা সেতুতে সকালে কয়েকটি যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে যানজট প্রকট আকারে রূপ নেয়।
শিমরাইল ট্রাফিক ইনচার্জ (টিআই) পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত ৩টি গাড়ি কাঁচপুর সেতুর উপর উঠতে গিয়ে বিকেল হয়ে পড়ায় সড়কে যানজট শুরু হয়। তিনি বলেন, সব সময় কাঁচপুর সেতুর পাশে একটি রেকার রাখা হয়েছে, কোনো যানবাহন বিকল হলে সাথে সাথে ওই রেকার দিয়ে সরানো হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকাল থেকেই আরামবাগের বিলাসবহুল কাউন্টারগুলো থেকে ঘরমুখো মানুষ নিয়ে বাসগুলো যাত্রা শুরু করে। দুপুরের দিকে সামিউল নামের এক যাত্রী বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে কাউন্টার পর্যন্ত আসতেই তো চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। পথে যে কতো ভোগান্তি হবে তাতো এখনো বলা যাচ্ছে না।
এদিকে, শুরুর দিনই যানবাহনগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু হয়ে গেছে। ফাহিম নামের এক যাত্রী বলেন, রাজধানীর গুলিস্তান থেকে মাওয়ার ভাড়া ৭০-৮০ টাকা। সেখানে গতকালই ১৫০ টাকা আদায় করা হয়েছে। যাত্রীদের চাপ দেখে সকাল থেকে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। ঈদ বকশিসের নামে এই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে ঢাকা-সিলেট-চট্রগ্রাম মহাসড়কের মতো ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কেও গতকাল দিনভর তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে। এতে করে উত্তরাঞ্চলে যাতায়াতকারী মানুষ পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। রাস্তায়ই অনেকের কেটে ১৩/১৪ ঘণ্টা।

ফেরিঘাটে ভোগান্তি: এদিকে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। গতকাল সবক’টি ফেরিঘাট সচল করা সম্ভব হয়নি। ঘাট সূত্র জানিয়েছে, ঘাটের দু’পাশে শত শত যানবাহন আটকে আছে। এরমধ্যে অধিকাংশই যাত্রীবাহী যানবাহন। এই যাত্রীরা মারাত্মক ভোগান্তিতে রয়েছে। গতকাল সকাল থেকে ওই ঘাটে যানবাহনের সারি ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। ওপারে দৌলতদিয়ায় চারটি ঘাটের মধ্যে দুটি অচল থাকায় পারাপারে সমস্যা হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পাটুরিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, পাটুরিয়ার পাঁচটি ঘাটের সব কটি সচল রয়েছে। তবে দৌলতদিয়ায় চারটি ঘাটের মধ্যে দুটি অচল। এ কারণে ওপারে ফেরি যাওয়ার পর যানবাহন ও যাত্রী পারাপারে জট সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মার ওই পারে নদীর প্রচণ্ড স্রোত। একই সঙ্গে পাড়ে ভাঙন চলছে। দৌলতদিয়া তিন নম্বর ঘাটে দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা মেরামত কাজ চলার পর বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে তা ভেঙে যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ওপার থেকে ফেরিগুলো ফিরতে দেরি হবে। এ কারণে হয়তো এপারে পরে একটা চাপ পড়তে পারে।

লঞ্চযাত্রায় ভোগান্তি: ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিন নৌপথে ঘরে ফিরছে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। এই ঘরে ফেরার যাত্রায় থাকে নানান রকমের ঝক্কিঝামেলা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস। দীর্ঘদিন পর প্রাণের টানে প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে নৌপথে রওনা দেয়া এইসব মানুষের চোখে যেনো আনন্দের ছটা। গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ৭টায় নির্ধারিত সময়ে ধারণ ক্ষমতার কিছুটা বেশি যাত্রী নিয়েই চাঁদপুরের উদ্দেশে ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল ছেড়ে আসে সোনার তরী-১ লঞ্চটি। ধীরে ধীরে সময় যতো গড়ায়, সন্নিকট হয় গন্তব্য। সেই সঙ্গে নদীর উত্তাল রাশির ঢেউ যেনো আনন্দরাশি হয়েই আছড়ে পরে ঘরে ফেরা মানুষের মনে। গত কয়েক বারের চেয়ে এবারের ঈদে লঞ্চযাত্রায় ভোগান্তি কিছুটা কম বলে জানালেন যাত্রীরা। তবে ছিনতাইকারী চক্র ও মলম পার্টির উৎপাতের ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই। দেখতে দেখতে লঞ্চটি পৌঁছে যায় চাঁদপুরে। শেষ হয় যাত্রার পালা। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা যাত্রা শেষে লঞ্চটি চাঁদপুর টার্মিনালে পৌঁছার পর সবাই ছুটেন আপন ঘরে।

http://www.dailysangram.com/post/334273