১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৮

হিসাব খোলায় কড়াকড়ি হয়রানির মুখে গ্রাহক: তথ্য না মিললেই ব্যাংক হিসাব স্থগিত ; ঝুঁকি তালিকায় স্বল্পআয়ের মানুষও ; এপিজির বিধি পরিপালনে এ নীতিমালা

অর্থ পাচার রোধে ব্যাংকে হিসাব খোলা ও পরিচালনায় ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ঝুঁকির তালিকা ও গ্রাহক পরিচিতি (কেওয়াইসি) ফরমে বড় রদবদল এসেছে। অতিরিক্ত নানা তথ্যের সঙ্গে দিতে বলা হয়েছে অন্য ব্যাংকে হিসাবের সুনির্দিষ্ট তথ্যও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এ নীতি কার্যকরে হিমশিম খাবে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে গ্রাহকের ভোগান্তির মাত্রা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। তাদের আশংকা, আইনের কড়াকড়ির ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে যেতে পারেন। তখন হুন্ডি ও কো-অপারেটিভ সোসাইটির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে লেনদেন বেড়ে যাবে। টাকা চলে যাবে ব্যাংকের বাইরে। এর ফলে প্রতারণার মাত্রা আরও বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংকিং খাত।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকে হিসাব খোলায় জাতীয় পরিচয়পত্রই যথেষ্ট। এর বাইরে তেমন কিছুর দরকার নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন এমন কাগজপত্র চাচ্ছে তাতে গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হবেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলারের মাধ্যমে হিসাব খোলা ও পরিচালনায় নতুন নীতিমালা জারি করেছে। এ সার্কুলারে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এফডিআর, নাবালক, চলতি ও সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব খোলার ক্ষেত্রে আলাদা ফরম তৈরি করে দিয়েছে। একই সঙ্গে লেনদেনের বিবরণীর বিষয়েও আলাদা একটি ফরম্যাট দেয়া হয়েছে। এতে আগের চেয়ে বিধিবিধান কঠোর করা হয়েছে। এখন নতুন নিয়মেই ব্যাংক হিসাব খুলতে ও পরিচালনা করতে হবে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) বিধিবিধান পরিপালন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা সংস্থা-বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ নীতিমালা জারি করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, হিসাব খোলার ফরম ও গ্রাহক পরিচিতি (কেওয়াইসি) সম্পর্কে এখন অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির কারণে এটি করা হচ্ছে। এসব বাস্তবায়ন না করলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।

সার্কুলার অনুযায়ী, স্বল্পআয়ের গ্রাহকরাও ঝুঁকির মাত্রায় চলে এসেছেন। তারাও কঠোর তদারকির আওতায় আসছেন। একই সঙ্গে ঝুঁকির তালিকায় নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও যোগ হয়েছে। এ তালিকায় নতুন আসা জমি ও বাড়ি কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান ও শিপ ব্রেকিং ব্যবসাকে সর্বোচ্চ ঝুঁকি ৫ নম্বর রেটিংয়ে ফেলা হয়েছে। ক্লিয়ারিং, ফরোয়ার্ডিং, আউটসোর্সিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট, কর্পোরেট কাস্টমার, ল’ফার্ম, ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেল এজেন্ট, চামড়া ব্যবসা, টেলিকমিউনিকেশন খাতকে ঝুঁকির তালিকায় এনে ৪ নম্বরে রেটিং করা হয়েছে। হিমায়িত পণ্যের ব্যবসা, অ্যাগ্রো ব্যবসাকে নতুন করে ঝুঁকির তালিকায় এনে ৩ নম্বরে রেটিং করা হয়েছে।

কিছু খাতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক, লিজিং, ফাইন্যান্স কোম্পানি, ইন্স্যুরেন্স, শেয়ারের ব্রোকার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তামাক ও সিগারেটের ব্যবসা ছিল ৩ নম্বর ঝুঁকি রেটিংয়ে, এখন এসব সর্বোচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ ৫ নম্বর রেটিংয়ে ফেলা হয়েছে। সফটওয়্যার ব্যবসা ২ থেকে ৫ নম্বর ঝুঁকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চাকরিজীবীরা আগে ছিল ঝুঁকিপর্ণ ২ নম্বর তালিকায়। এবার তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। ছাত্রদের ৩ নম্বর ঝুঁকি থেকে কমিয়ে ২ নম্বরে নামিয়ে আনা হয়েছে। গৃহিণীদের ঝুঁকির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে।

আগে গ্রাহকের নিট সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি হলে তা ঝুঁকিমুক্ত ছিল। বর্তমানে তা ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত। এর বেশি সম্পদ হলেই ঝুঁকির আওতায় চলে আসবেন গ্রাহকরা। আগে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিট সম্পদ হলে তার ঝুঁকির মাত্রা ছিল সর্বনিন্ম ১ রেটিংয়ে। বর্তমানে তা কমিয়ে ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা করা হয়েছে। আগে ৩ কোটি টাকার বেশি নিট সম্পদ হলে ঝুঁকির মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৩ রেটিংয়ে। বর্তমানে ২ কোটি টাকার বেশি নিট সম্পদ হলেই তিনি সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন।

ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রেও ঝুঁকির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। সরাসরি ব্যাংকে গিয়ে হিসাব খুললে আগের মতো বর্তমানেও কোনো ঝুঁকি নেই। তবে ডিরেক্ট সেলস এজেন্টের মাধ্যমে হিসাব খুললে ঝুঁকির মাত্রা ২ থেকে বাড়িয়ে ৩ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ও অযাচিতভাবে হিসাব খুললে ঝুঁকির মাত্রা আগের মতো ৩ রেটিংয়েই রয়েছে।

নতুন হিসাব খোলার সময় অন্য ব্যাংকে গ্রাহকের হিসাব সম্পর্কিত সব তথ্য দিতে হবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট ছক করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটি দিলে গ্রাহকের হিসাবের গোপনীয়তা আর থাকল না। এতে কোনো ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ইচ্ছা করলে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ও নিতে পারেন। এতে গ্রাহকের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। এ ছাড়া টাকা জমা ও তোলার সময় নানাভাবে নানা ধরনের কাগজপত্র দেয়ার বিধান করা হয়েছে, যা অত্যন্ত জটিল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। হিসাব খোলার ফরমের সঙ্গে তথ্য না মিললেই হিসাব স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে গ্রাহকরা জরুরি প্রয়োজনে টাকা তুলতে পারছেন না। এটিএম বুথেও লেনদেন করা যাচ্ছে না।

এতে গ্রাহক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেওয়াইসি (গ্রাহক পরিচিতি) ফরমে আগে প্রতিষ্ঠানের মাসিক আয়ের পরিমাণ দেখানো হতো। নতুন ফরমে ব্যক্তি-গ্রাহকের মাসিক আয়ের পরিমাণ সংযুক্ত করে তা ঝুঁকি স্কোর দেয়া হয়েছে। যেমন গ্রাহকের মাসে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের ঝুঁকি ধরা হয়েছে নিন্মমানের। এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঝুঁকি দেখানো হয়েছে মধ্যমানের এবং তিন লাখ টাকার ওপর লেনদেনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি দেখানো হয়েছে উচ্চমানের। আগে গ্রাহকের মাসিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার ওপরে হলে উচ্চমানের ঝুঁকি বলা হতো। নতুন সার্কুলারে তা ২০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। অনুরূপভাবে আগে গ্রাহকের মাসিক লেনদেনের সংখ্যা ২৫০টির অধিক হলে তা উচ্চমানের ঝুঁকি হিসেবে ধরা হতো, এখন তা ২৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে ১০০টি লেনদেন পর্যন্ত কোনো ঝুঁঁকি দেখানো হতো না, এখন তা ১৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। নমিনির ক্ষেত্রে আগে একজন হলেই চলত, এখন একাধিক নমিনি রাখার বিধান করা হয়েছে।


http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/15/101146/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AC-%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%95%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%9C%E0%A6%BF-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B9