২৭ মে ২০১৮, রবিবার, ১১:৩৫

‘ওদের ফিরিয়ে দিন’

আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবাকে ফেরত চাই। অন্যদের মতো বাবার হাত ধরে আমিও হাঁটতে চাই। বাবার সাথে ঈদ করতে চাই। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন, নাহলে আমাদেরও নিয়ে নিন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবেই বাবার সন্ধান চাইছে নিখোঁজ চালক কাওসারের শিশুকন্যা লামিয়া আক্তার মীম। শুধু বাবা হারানো ছোট্ট মীমই নয়, কেউ সন্তান হারিয়ে, কেউ স্বামী হারিয়ে, কেউবা ভাই হারিয়ে স্বজন হারিয়ে তাদের ফিরে পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে নিখোঁজ হওয়া-গুম হওয়া স্বজনের ছবি বুকে নিয়ে। তাদের একটাই দাবি, ঈদের আগে তাদের স্বজনদের ফিরে পাওয়া। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্তর্জাতিক গুম সপ্তাহ উপলক্ষে মায়ের ডাকের উদ্যোগে ঈদুল ফিতরের আগে গুম সদস্যদের পরিবারের ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে এ দাবি জানান তারা। এ সময় নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান মানবাধিকার কর্মীরা।

গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসির সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেনÑ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। গুম হওয়া পরিবারের মধ্যে বক্তব্য দেনÑ সাইফুল রহমান সজিবের বাবা শফিকুর রহমান, আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী, তরিকুল ইসলাম তারার স্ত্রী শামসুন্নাহার বেবী, মো: নুর আলমের স্ত্রী রিনা আলম, মাহবুব রহমান সুজনের ভাই জাহিদ খান, কাজী ফরহাদের ভাই আমান, ছাত্রলীগ রামপুরা থানার সভাপতি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা আলহাজ সালেহা বেগম, মাহবুবুর রহমান রিপনের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান শিপন, আমিনুল ইসলাম জাকিরের ভাই আলমগীর হোসেন আলিক, আদনান চৌধুরীর মা কানিজ ফাতেমাসহ উপস্থিত ছিলেনÑ আসাদুজ্জামান রানা, জাহিদুল করিম তানভীর ও আলামীনের পরিবারের সদস্যরা।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, সাত-আট বছর ধরে কারো ছেলে, কারো ভাই কারো বা স্বামী নিখোঁজ রয়েছেন। কারো বছর খানেক ধরে স্বজন নিখোঁজ রয়েছে। আজো তাদের হদিস মেলেনি। এদের একটাই দাবি, তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়া হোক। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, কারা নিয়ে গেছে তাদের। যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাসা থেকে যাদের নেয়া হয়েছে প্রত্যেকের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অথবা তাদের পোশাক পড়ে এসে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, কুমিল্লার সুবেদার মেজর মতিন বঙ্গবন্ধুর গার্ড রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। তার সন্তানকে র্যাব নিয়ে গেছে। সেটা উনি প্রকাশ্যে বলেছেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত তার ছেলে ফিরে আসেনি। শাহিনবাগের সাতজন সন্তানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে গিয়েছে। কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা সেখানে পালিয়ে ছিলেন সেখান থেকে। কাউকে বাসা থেকে। তারা বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত। তার মধ্যে একজন প্রাইভেটকার চালকও ছিলেন। যেভাবে যে পদ্ধতিতে নারায়ণগঞ্জের সাতজনকে উঠিয়ে নিয়েছিল ঠিক একই পদ্ধতিতে এদেরও নেয়া হয়েছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই সাতজন ফিরে আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট কোনো বক্তব্যে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, নিখোঁজ ও গুম হওয়াদের কি অবস্থা সেটা জানার জন্য একটা কমিশন গঠন করা হোক। কমিশন তদন্ত করে দেখবে এই যে লোকগুলো দীর্ঘ দিন ধরে নিখোঁজ বা গুমের শিকার হয়েছে তাদের অবস্থা কি। কি ঘটেছে তাদের জীবনে সেটা জানান চেষ্টা করবেন এবং যারা গুম খুনের সাথে যুক্ত তাদের বিচারের আওতায় আনবে।

তিনি আরো বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে আমরা দেখছি, একটা অভিযানের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এ হত্যার জবাব এক দিন দিতে হবে। প্রত্যেকটি গুম-খুনের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাংলাদেশ একটা মৃত্যুরদ্বীপ, মৃত্যুর উপত্যকা হয়ে গেছে। সম্প্রতি একটি অভিযানের নামে ৫৪ জন মানুষকে হত্যা করা হলো অথচ তাদের দোষ কি আমরা জানি না। এই যে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের স্বজনরা জীবিত না মৃত সেটা জানে না তারা। কারো ছেলে কারো ভাই কারো স্বামী হারিয়ে গেছে। কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো জবাবও পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, গত ১০ দিনে ৫৪ জন মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। ওনারা বলছেন, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। মন্ত্রী-র্যাব মহাপরিচালক বলছেন, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই রমজান মাসেই যুদ্ধটা কেন শুরু করতে হলোÑ প্রশ্ন করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু করলেন যাদের বিরুদ্ধে সেই বিরোধী পক্ষে করা? পত্র-পত্রিকাগুলোতে নাম আসছে কারা মাদকের সাথে জড়িত। তাদের বাড়ির ঠিকানাও আসছে। কোথা থেকে মাদক আসছে, কোন জায়গায় কোন বাড়িতে বিক্রি হয়। কারা কারা এগুলো পাচার করে। কারা বহন করে তাদের সবার নামই আসছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। একজন এমপির নাম ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, মন্ত্রী বলেছেন, তার বিরুদ্ধে মেলা অভিযোগ কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণের জন্য কোথায় কোথায় খুঁজেছেন। পুলিশ কি তদন্ত করেছে? আমাদের জানানো হোক।
তিনি বলেন, আমি প্রশ্ন করতে চাই যে ৫৪ জনকে হত্যা করলেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ আপনাদের কাছে কি কি আছে। প্রমাণ না থাকলে একজন এমপিকে যদি গ্রেফতার করতে না পারেন তাহলে প্রমাণ ছাড়া এতগুলো মানুষকে হত্যার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রমজান মাস নাকি সংযমের মাস। এই মাসেই মানুষ হত্যায় নতুন করে মেতে উঠেছে সরকার। আর সবকিছুর মূল আগামী একাদশ নির্বাচন। বিনা চ্যালেঞ্জে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এইসব টালবাহানা করছে। কিন্তু দেশবাসী আর ছাড় দেবে না। এই সরকারকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান এবং পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে গুম হওয়া স্বজনরা যেন তাদের পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে সেই আহ্বান জানান।

নিখোঁজ আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়শা আলী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি স্বজনহারা। আপনি বুঝেন স্বজন হারানোর বেদনা কেমন। আমরাও মা হিসেবে আপনার কাছে আমাদের সন্তানদের ফেরত চাই। আমরা আশাবাদী আপনি চাইলে আমাদের সন্তান ফিরে পাবো। সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের বাঁচতে দিন। নয়তো আমাদেরও নিয়ে নিন।
মারুফা ইসলাম ফেরদৌসি বলেন, আমার মা ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে কুঁজো হয়ে গেছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। তিনি বলেন, সুমনের মতো আজকে এখানে যারা উপস্থিত রয়েছেন সবার একই অপেক্ষা। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে কাছে পেতে চাই। তাদের সাথে ঈদ করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি তো আপনার স্বজনকে নিয়েই ঈদ করেন। তবে আমাদেরকে কেন ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন। আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, হয় গুম হওয়া সবাইকে ফিরিয়ে দিন না হয় আমাদের সবাইকে মেরে ফেলুন। এভাবে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ না করে একসাথে মরে যেতে চাই। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/320445