২৫ মে ২০১৮, শুক্রবার, ৯:২০

প্রতি মণ ধানে লোকসান তিন’শ টাকা কৃষকের মাথায় হাত

এইচ এম আকতার: এবার বোরো উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। ধানের বাম্পার ফলনে চাষিরা খুশি হলেও ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষকের মাথায় হাত। ২ মে থেকে সারা দেশে ধান-চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও সারা দেশে পুরোদমে সংগ্রহ শুরু হয়নি। এতে করে মধ্যসত্ত্বভোগীদের হাতে চলে যাচ্ছে কৃষকের ধান-চাল। ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়ে ৫০০-৫২০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। এতে করে প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে প্রায় তিন শত টাকা।

জানা গেছে, ধান উৎপাদনে একজন কৃষককে পানি থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত সব কিছুই ক্রয় করতে হচ্ছে উচ্চমূল্যে। সরকার আগে কৃষি খাতে ব্যাপকহারে ভর্তুকি দিলেও তা অনেকটা কমেছে। অন্যদিকে সরকারের কাছে ন্যায্যমূল্যও পায় না কৃষকরা। এতে করে উভয় দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। ধান উৎপাদনে যদি সরকারের সহায়তা পাওয়া যেতো তাহলে বাজার মূল্য কম পেলেও কৃষকের কোনো ক্ষতি হতো না। অথবা উৎপাদন অনুযায়ী যদি বাজার মূল্য পাওয়া যেতো তাতেও কৃষকের কোন ক্ষতি ছিল না। কিন্তু সরকারের কাছে তেমন উৎপাদন সহায়তা পাচ্ছে না তারা। এতে করে জমির মালিকরা ধান চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে সবজির চাষ করছেন।
জানা গেছে, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে একজন কৃষককে ব্যয় করতে হয় বিশ টাকা। এতে করে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ হয় ৮০০ টাকা। এ হিসাবে সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১০৪০ টাকা। এতে করে প্রতি কেজি ধানের মূল্য হয় ২৬ টাকা।
এ হিসাবে প্রতিমণ ধানের লাভ হওয়ার কথা ২৪০ টাকা। কিন্তু লাভ তো দুরের কথা উল্টো লোকসান গুণতে হচ্ছে কৃষকদের। এতে করে সারা দেশের কৃষকরা হতাশ। ক্ষোভ প্রকাশ করে মাগুরার কৃষক আহাদ আলী বলেন, আমাদের হাত থেকে ধান ব্যবসায়ীদের (মধ্যসত্ত্বভোগী) হাতে চলে গেলে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে থাকেন। এতে করে বর্ধিত মূল্য সাধারণ কৃষকরা পায় না। সরকারের এ টাকা চলে যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে।

চলতি মৌসুমে ধান ও চাল মিলে ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সচিবালয়ে খাদ্য পরিধারণ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। খাদ্যমন্ত্রী জানান, ২৬ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান। আর ৩৮ টাকা কেজি দরে সংগ্রহ করা হবে ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল। ২ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই চাল ও ধান সংগ্রহ চলবে।
সারা দেশে ধানের বাম্পার ফলন তারপরও চালের বাজারে সুবাতাস নেই। কোনো ভালো মানের চালই কেজিতে ৬০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত কাজ করে এ জন্য প্রয়োজন সক্রিয় নজরদারি। এর পাশাপাশি উৎপাদনে দক্ষতা বাড়ানোরও পরামর্শ তাদের। বন্যা, অব্যবস্থাপনা ও মধ্যসত্বভোগীদের দৌড়াত্ব নানা ইস্যুতেই বাড়তি দামের কারণে প্রায় দেড় দুই বছর যাবৎ আলোচনায় চালের বাজার।
দাম কমাতে আমদানি শুল্ক কমানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজারে বড় কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। এরই মধ্যে মৌসুমের চালও এসেছে বাজারে। কয়েকমাসে বিভিন্ন জাতের চালে কেজিতে দুই-এক টাকা দাম কমলেও ভালো মানের চাল কিনতে এখনও ভোক্তাকে কেজিতে ৬০ টাকার বেশিই খরচ করতে হচ্ছে।

জানা যায়, এ মৌসুমে বোরো’র ইতিবাচক ফলন হয়েছে। যদিও, এবারও কাঙিক্ষত দাম পাচ্ছেন না, কৃষক। অন্যদিকে, প্রধান আমদানিকারক দেশ ভারতে সম্প্রতি চালের দাম প্রতি টনে তিন ডলার কমেছে। বলা হচ্ছে গেল পাঁচ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ভালো ফলন আর আমদানি করা চালের দাম কমার ফলে বাজারে উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাব পড়ার কথা। তাদের মতে, চালের উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দক্ষতার পাশাপাশি বাড়াতে হবে নজরদারি।
বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের বরো উৎপাদনে অনেক বেশি। আমন উৎপাদনে কৃষকরা খুশি হতে না পারলেও বরো উৎপাদনে কৃষকের মুখে হাসি দেখা দেয়। একমাস বা তার সামান্য আগে পরে বোরর ফসল অর্থাৎ ধান কৃষকরা তুলতে শুরু করে। কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলতে যেয়ে ঝড় বর্ষার মুখোমুখি হয়। ঝড় বৃষ্টির ধকল মোকাবিলা করে কৃষকরা ঘরে ধান তুললেও আশানুরুপ মুল্য হতে বঞ্চিত হয়।

বর্তমান বাজার মুল্য পূর্বের অপেক্ষা কম, ধান উৎপাদনে কৃষকের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক আর আলোক উজ্জ্বল সমিহ বিচ্ছুরণ হলেও বর্তমান সময়ে ধানের মুল্য কমে যাওয়ার বিষাদের ছায়া ভর করেছে কৃষকদের। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা বিভিন্ন সমিতি মহাজন, আড়তদার, মিল মালিকদের নিকট হতে ঋণ এবং ধার নিয়ে কৃষি খরচ চালিয়েছে পাশাপাশি কীটনাশক বীজ, সার অনেকে বাকিতে ক্রয় করেছে, কেউ কেউ চড়া সুদে ঋন নিয়ে চাষাবাদ করেছে। ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবে এটাই শর্ত।

কিন্তু বর্তমান সময়ে ধানের মুল্য কৃষকের কাঙ্খিত মূল্য অপেক্ষা অনেক কম। বর্তমান বাজার মূল্যে কৃষকরা ধান বিক্রি করলে লাভতো পরাহত প্রকৃত খরচ ও উঠবে না। কৃষকদের প্রত্যাশা সরকারিভাবে অর্থাৎ সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করা, বাস্তবতায় খাদ্য বিভাগ এখনও পর্যন্ত ধান ক্রয় শুরু করেনি কৃষকরা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন সেই সাথে ঋণ, দেনা পরিশোধ করার লক্ষে কমমূল্যে ধান বিক্রি করছে।
কৃষক, ধান ব্যবসায়ীসহ মিল ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ধান বাজারে একটি চক্র নিজেদের প্রভাব, প্রতিপত্তি বিস্তৃত করে চলেছে। এরই মধ্যে উক্ত চক্র কৃষকদের নিকট হতে কমমূল্যে ধান ক্রয় করছে এবং পরবর্তিতে তা সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের সময় বেশি দামে অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করবে। বর্তমান সময়ে যদি সরকারিভাবে ধান ক্রয় করা হতো তাহলে কৃষকদের মাঝে চক্র, সিন্ডিকেট বা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের অস্তিত্ব থাকতো না। কৃষকরা অবিলম্বে সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের দাবি জানিয়েছেন।

সরকারিভাবে ধান ক্রয় শুরু না হলেও চাল ক্রয় শুরু হয়েছে। চলতি মাসের দশ তারিখ হতে চাল ক্রয় শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে জেলা খাদ্য অফিস সূত্রে। চাল ক্রয় বিষয়ে অভিযোগের অন্ত নেই, এক্ষেত্রে চক্র, সিন্ডিকেট, মিলারসহ সুবিধাভোগীরা একাকার, সাতক্ষীরা জেলা খাদ্য কর্মকর্তা জাকির হোসেনের সাথে ধান ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ধান ক্রয়ের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত নির্দেশনা তথা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হইনি।
চাল ক্রয়ে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন চুক্তিবদ্ধ মিলারদের নিকট হতে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাল ক্রয় করা হচ্ছে। এখানে অনিয়মের সুযোগ নেই, তিনি জানান সাত হাজার ছয়শত চৌত্রিশ মেট্রিকটন চাল ক্রয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করে দিয়েছে অধিদপ্তর। প্রতি কেজি চাল আট ত্রিশটাকা দরে ক্রয় করা হচ্ছে। কৃষকদের বক্তব্য চাল অপেক্ষা ধান ক্রয়ের বিষয়টি আগে হওয়া আবশ্যক। কারণ চাল ক্রয় করা হয় নির্দিষ্ট সংখ্যক চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের নিকট হতে অন্যদিকে ধান বিক্রি করার সুযোগ পায় প্রান্তীক পর্যায়ের কৃষকরা। অবশ্য বিগত বছরগুলোতে ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রেও মধ্যস্তত্ব ভোগী মহল বিশেষের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট।

জানা গেছে সারা দেশে বোর’র বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিটি জেলায় বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু তাতে কোন লাভ নেই কৃষকের। প্রতি মণ ধানের যেখানে কৃষকের লাভ হওয়ার কথা সেখানে উল্টো লোকসান গুণতে হচ্ছে কৃষককে। এনিয়ে সরকারের কোন নজরদারি নেই।
কৃষকদের অভিযোগ সরকার কৃষকের কথা চিন্তা করে সারা দেশে গত বছর থেকে ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এতে কৃষকরা কিছুটা লাভবানও হয়েছিল। কারণ হিসেবে কৃষকরা বলেন এ বর্ষার মওসুমে ধান সিদ্ধ করে চাল করা খুবই কঠিন কাজ। সরকার যদি সরাসরি ধান ক্রয় করে তাহলে আমাদের অনেক লাভ হয়্ কিন্তু সরকার ধানের চেয়ে চাল বেশি সংগ্রহ করে থাকে। এতে করে লাভ চলে যায় মিল মালিকদের হাতে। কৃষক কোনো লাভ পায় না।

জানা গেছে ধান উঠান সাথে সাথে মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করতে হয় কৃষকদের। কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধানের দাম না পেয়ে লোকসানে বিত্রি করতে হচ্ছে। ধান সংগ্রহের নির্ধারিত তারিখ থেকে ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও ধান সংগ্রহ শুরু করেনি সরকার। এতে করে কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের হাত হয়ে তা চলে যাচ্ছে মিল মালিকদের কাছে। এতে করে কৃষকের কোন রাভ হচ্ছে না।

কৃষকদের দাবি সরকার যদি চালের তুলনায় বেশি করে ধান ক্রয় করতো তাহলে কৃষকরা লাভবান হতো। একইভাবে সরকার যদি নির্ধারিত সরকার ধান-চাল ক্রয় শুরু করতে পারতো তাহলেই কৃষকরা কিছুটা লাভবান হতো।
কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল ক্রয় করতে পারলেই কৃষক উপকৃত হতো। কিন্তু সরকার তা না করে নির্ধারিত সময়ের পরে ধান-চাল ক্রয় করছে। এতে করে সরকারের টাকা চলে যাচ্ছে ফড়িয়ার পকেটে। এনিয়ে সরকারকে এক্ষণি ভাবতে হবে। সরকারের বাজার মনিটরিং যদি সক্রিয় হতো তাহলে ন্যায্যমূল্য পেতো সাধারণ কৃষকরা।

http://www.dailysangram.com/post/331694