২৪ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৪

চার মাসে ১২১২ খুন

দেশজুড়ে বাড়ছে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে খুনের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের শুরুর চার মাসের চেয়ে চলতি বছরের চার মাসে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ১৯ হাজার ৬৭৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫১৪, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৬, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৯১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৫৪৯ ও চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ২১২ হত্যাকাণ্ড হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসের খুনের তুলনায় ২০১৮ সালে খুনের সংখ্যা বেড়েছে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৬৩টি। অথচ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে খুন হয়েছে ২৯১ জন। একইভাবে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ২৫০টি, মার্চ মাসে ২৯৭, এপ্রিল মাসে ২৯৭। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি ২৫৬, মার্চে ৩২৭, এপ্রিলে ৩৩৮টি। পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত বছরের চার মাসের তুলনায় চলতি বছরের চার মাসের খুনখারাবির সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি এসব খুনখারাবির ধরনও বেশ পাল্টেছে। নৃশংস, লোমহর্ষক ও অভিনব কায়দায় এখন হত্যাকাণ্ড ঘটছে।

১৯শে মে মৌলভীবাজারে শাশুড়িকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন এক জামাতা। ৫৫ বছর বয়সী ওই নারীর নাম রোকেয়া বেগম। হত্যাকারী জামাতার নাম আলি হোসেন। গভীর রাতে তার নিজ বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের মাতারকাপন গ্রামের রাজ্জাক মিয়ার স্ত্রী। মেয়ে ও জামাতার সঙ্গে একই সঙ্গে শহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকার একটি বাসায় থাকতেন। রোকেয়ার পরিবার জানিয়েছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে তার জামাতা দা ও শাবল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ১৮ই মে শুক্রবার সন্ধ্যায় সীতাকুণ্ড পৌরসভার জঙ্গল মহাদেবপুর পাহাড়ের ত্রিপুরাপাড়া থেকে ফলিন ত্রিপুরার মেয়ে সুখলতি ত্রিপুরা (১৫) ও সুমন ত্রিপুরার মেয়ে ছবি রানী ত্রিপুরার (১১)-এর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তারা দুজনেই বান্ধবী। পুলিশ জানিয়েছে, ওই দুই কিশোরীকে ধর্ষণের পর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ছবি রানী ত্রিপুরার বাবা সুমন ত্রিপুরা বাদী হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় স্থানীয় চৌধুরীপাড়ার ইসমাঈল হোসেনের ছেলে আবুল হোসেনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।

অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের ভয়াল বিস্তার, পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতি, পরকীয়া, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, অতিমাত্রায় ক্ষোভ, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে বন্ধ হচ্ছে না অপরাধ। এছাড়া বরাবরই নির্বাচনকালে বছরে দেশে অন্যরকম এক অস্থিরতা বিরাজ করে। তাই নির্বাচনের বছর আসলে অপরাধীরা বেশি তৎপর হয়ে উঠে। সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়াতে এ বছরে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সময় যত যাবে অপরাধ আরো বাড়বে। কারণ, এসময় ঝিমিয়ে পড়া সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সজাগ হয়। নেতাকর্মীরা তাদের প্রয়োজনে অপরাধীদের ব্যবহার করান। নির্বাচনকালীন আধিপত্য বিস্তারের একটা বিষয় থাকে। এসময় জেলে থাকা অপরাধীদের জামিনে বের করা হয়। সূত্র আরো জানিয়েছে, দেশে এখন মাদকের ভয়াবহতা খুব বেড়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। আর এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষই মাদকের সঙ্গে জড়িত।

অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সময়ের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনা করা দেখা গেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় গণতান্ত্রিক চর্চাটা খুব কম হচ্ছে। এর কারণে সব দলের মধ্যে একটা পাওয়া না পাওয়ার প্রবণতা রয়ে যায়। কে কার চেয়ে বেশি পেতে হবে। আমি কেন কম পেলাম। এ ধরনের কিছু বিষয় থেকে একটা রাজনৈতিক ক্ষোভ তৈরি হয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, রাজনৈতিক ক্ষোভটা একটাই পৈচাশিক হচ্ছে খুনের পর মরদেহের ওপরও সেই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বিকৃত করার পাশাপাশি অনেক সময় খণ্ডিত করা মরদেহ। এর বাইরে সামাজিক কারণে ঘটে যাওয়া ঘটনারও কমতি নেই। সম্পত্তির জের, পরকীয়া, কলহ থেকে সামাজিক হত্যাকাণ্ড ঘটে।

এর কারণ হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার দায়দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে আছে। একটা সামাজিক বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে যা দরকার সেটা তারা করছে না। এজন্য মানুষের মধ্যে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে। সমাজ কল্যাণ বিভাগের এই শিক্ষক মনে করেন, সামাজিক চর্চাটা ভালোভাবে করা দরকার। শুধু আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা দিয়ে হবে না। কারণ, তাদের তৎপরতা অপরাধ হওয়ার পর দেখা যায়। তবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক সংস্থাগুলোতে মানবিকতার চর্চা দরকার। তাহলেই আমারা একটি সুন্দর, সংঘাতবিহীন সমাজ পাবো।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেলি ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মাদক অন্যতম। আবার পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, ইন্টারনেটের অপব্যবহার আছে। এর বাইরে ধর্ষণের পর ও পরকীয়ার জের ধরে থেকে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটে। তিনি বলেন, পুলিশ কখনই চায় না দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হোক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশ সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। খুনের ঘটনা ঘটলে আসামিদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=118659