২৪ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৫

ভূত তাড়ানোর কাজটা এখন কঠিন হয়ে উঠেছে

গ্যাংস্টারদের দৌরাত্ম্য কি থামার নয়? হঠাৎ করে আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকার গ্যাংস্টার। ঈদ সামনে রেখে পাড়ায়-মহল্লায় নিত্যনতুন গ্যাংয়ের জন্ম হচ্ছে। ওরা জড়াচ্ছে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধে। নামে-বেনামে অনেক গ্যাং বা চক্র গড়ে উঠেছে। এরা শুরুতে ফ্যাশন, ফ্যান্টাসিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব অপরাধে। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়ায় এসব কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে এরা। অনেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের হাতিয়ার হিসেবে। প্রতিনিয়ত ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত হচ্ছে এদের হাতে। রমযান শুরু হতে না হতেই বাড়িওয়ালা, মার্কেটের ব্যবসায়ী, ফুটপাথের দোকানদার ও ইফতার বাজারের বিক্রেতাদের কাছে ঈদ বকসিসের নামে চিরকুট পাঠাতে শুরু করেছে গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা।

২০ মে এ ব্যাপারে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাংস্টারদের তৎপরতায় জনসাধারণ অতিষ্ঠ হলেও নির্বিকার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে ভ্যা-ভ্যা শব্দে মোটরসাইকেল রেস, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব ছাড়াও এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনখারাবি করতেও দ্বিধা করে না গ্যাংস্টার সদস্যরা। মাঝে কিছুদিন দমে গেলেও রমযানে বিভিন্ন এলাকায় বখে যাওয়া কিশোরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। বিভিন্ন বাসাবাড়ির বাসিন্দাদের কাছে এরা ‘সাহরি পার্টি’ নামেও আবির্ভূত হচ্ছে। ভয়ংকর এসব কিশোরের ভয়ে অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। ফলে নানা শ্রেণির পেশার মানুষের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগ। আর নেপথ্যে থেকে গ্যাংস্টারদের মদদ দিচ্ছেন মহল্লার কোন কোন রাজনৈতিক বড় ভাই। যে কোনো অপকর্ম করতে এদের কোনো কুণ্ঠা নেই। হত্যাকাণ্ডের মত নৃশংস ঘটনাও অবলীলায় ঘটাচ্ছে তারা।

এরা পাড়ায়-মহল্লায় দল বেঁধে চলাফেরা করে। স্কুল-কলেজের মেয়েদের দেখলেই মেতে ওঠে ইভটিজিং-এ। রাজধানীর উত্তরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আদাবর, পুরাতন ঢাকা, মতিঝিল, কাকরাইল, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এদের বিচরণ। এদের মধ্যে রয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানও। এলাকাবাসীর অভিযোগ র্যাবব-পুলিশের বিশেষ নজরদারি না থাকায় বখে যাওয়া কিশোররা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আমরা মনে করি, আলোচ্য ক্ষেত্রে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। কারণ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তো তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
কর্তব্যকর্মে অবহেলার বড় কারণ নৈতিক অধ:পতন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মধ্যেই জানা গেল, খোদ রাজধানীর মুগদা থানার সাত পুলিশ কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন। টাকা নিয়ে মাদক বেচাকেনার সুযোগ করে দিতেন তারা। মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করা সাত পুলিশ কর্মকর্তার নাম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ওই সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে মুগদা থানা থেকে প্রত্যাহার করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন মুগদা থানার ওসি মো. এনামুল হক।

দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের বিপরীত চিত্র শুধু মুগদা থানার কিছু কর্মকর্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গত ২০ মে রোববার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নরসিংদীর বেলাব থেকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। তিনি বেলাব থানার এসআই মোরশেদ হোসেন। এর আগে গত সপ্তাহে রাজবাড়ী থেকে হাইওয়ে রেঞ্জের এসআই বেলাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জ সদর থানার এএসআই সোহরাওয়ার্দী হোসেন, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার কনস্টেবল আসাদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া গত ২৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া এই পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ও মজনু ছাড়া বাকি ৩ জন অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
একেই বোধ হয় বলা হয়, শর্ষের ভেতর ভূত! এ জন্যই তো আমাদের সমাজে ভূত তাড়ানোর কাজটা এত কঠিন হয়ে উঠেছে। খোদ পুলিশ কর্মকর্তাই যদি মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে যায় কিংবা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মাদক ব্যবসা বন্ধ হবে কেমন করে? তবে আশার কথা, এই সব অপরাধীরা চিহ্নিত হচ্ছে, গ্রেফতারও হচ্ছে। এখানে বলার মতো বিষয় হলো, পুলিশের মধ্যে বিরাজমান অপরাধীদের চিহ্নিত করার কাজটি যেন শুধু কোনো বিশেষ অভিযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। সারা বছরই যেন এই কার্যক্রম চালু থাকে। এ ছাড়া পুলিশে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন এখন সমাজে বড় হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে সরকার এবং পুলিশের করণীয় আছে বলে আমরা মনে করি।

পুলিশের বর্তমান মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানির বিষয়টি নিয়ে সমাজে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরাতো যুদ্ধের মধ্যে নেই। একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে বাস করছি। প্রতিদিন পাঁচ-ছয়জন করে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলে উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা।’ তিনি প্রশ্ন করেন, এভাবে মাদক-সন্ত্রাস দমন করতে হচ্ছে কেন? আর কোনো উপায় কি নেই? সুলতানা কামাল আরো বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে আরো কঠোর হতে হবে। তবে অপরাধী যত দুর্ধর্ষই হোক না কেন, এর বিচার আইনের আওতায় হতে হবে।

সরকারের বাহিনীকে বন্দুক দেওয়া হয়েছে ব্যবহারের জন্য, কিন্তু সেই সঙ্গে বন্দুক ব্যবহারের বিধিও দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বিধিবিধান মেনে বন্দুক ব্যবহার করতে হবে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাখ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করে সুলতানা কামাল বলেন, আসলে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছে কিনা, কিংবা বন্দুকের অপব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেটা আমাদের জানা দরকার। এখানেও বিধিবিধান ও নৈতিকতার প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যাকন্ড করা যাবে না, এই অধিকার কারো নেই।

 

http://www.dailysangram.com/post/331631