জ্বলছে না রান্নার চুলা, স্থবির কারখানায় উৎপাদনের চাকা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৬

চট্টগ্রামে তীব্র গ্যাস সঙ্কটে চরম দুর্ভোগ

চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। রান্নাঘরে চুলা জ্বলছে না। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন আবাসিক গ্রাহকেরা। বন্ধ হয়ে গেছে গ্যাসভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৪টি ইউনিট। সিএনজি স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ লাইনে থেকে গ্যাস পাচ্ছে না সিএনজিচালিত যানবাহন। উৎপাদনের চাকা বন্ধ হওয়ার পথে গ্যাসনির্ভর কল-কারখানাগুলোর। গ্যাসের সাথে পাল্লা দিয়ে শীতকালেও বাড়ছে বিদ্যুৎ সঙ্কট।
চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট দীর্ঘদিনের। তার ওপর হঠাৎ করে সরবরাহ আরো কমিয়ে দেয়ায় সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত তিন দিন থেকে প্রায় পুরো নগরজুড়ে আবাসিক খাতে গ্যাস সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সকাল ৬টার পর থেকে রাত পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না। অনেক এলাকায় রাত ১১টার পর গ্যাস আসছে। এতে করে বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁতেও চলছে গ্যাস সঙ্কট। এতে করে চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি নগরবাসী।
নগরীর জামালখান, মোমিন রোড, হেমসেন লেইন, আসকারদীঘি, রহমতগঞ্জ, চকবাজার, হামজারবাগ, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, এনায়েত বাজার, আগ্রাবাদ, হালিশহর, মুরাদপুর, হাজীপাড়া, মৌলভীপাড়াসহ বেশিরভাগ এলাকায় সারাদিন গ্যাস থাকছে না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখা যায় গ্যাস নেই। হোটেল-রেস্তোরাঁতেও খাবার মিলছে না। এতে করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সকালের নাশতা এবং স্কুলের টিফিন দিতে পারছেন না অভিভাবকেরা। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। আবেদিন কলোনির বাসিন্দা উত্তম সেনগুপ্ত বলেন, গত কয়েক দিন ধরে ভোরে গ্যাস চলে যাচ্ছে। রাতে গ্যাস এলেও চাপ খুব কম থাকায় চুলা জ্বলছে নিভু নিভু করে। এতে করে রান্নাবান্না ব্যাহত হচ্ছে। হেমসেন লেইনের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন জানান, সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ মিলছে না। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। রাত জেগে অনেকে রান্না করছেন। ফ্রিজে রাখা খাবার দিনের বেলায় ঠা-া অবস্থায় খেতে হচ্ছে। নতুন আবাসিক এলাকা এবং মূল পাইপলাইনের দূরবর্তী পাহাড়ি এবং অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা ও বহুতল ভবনে গ্যাস সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তারা জানান, একদিকে জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সিইউএফএল সার কারখানা চালু করা হয়েছে। এ কারণে নগরীতে আবাসিক খাতে গ্যাস সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা জানান, হঠাৎ করে চট্টগ্রামে ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ না বাড়ালে এই সঙ্কট সহজেই কাটবে না বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তারা।
গত শনিবার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল) চালু হওয়ার পর থেকে নগরীতে আবাসিক খাতে গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আগে চট্টগ্রামে প্রতিদিন ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেত। ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে আবাসিকে কোনো সঙ্কট থাকে না। হঠাৎ করে গত শনিবার থেকে দেয়া হচ্ছে ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্য থেকে কাফকোকে দিতে হচ্ছে ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, সিইউএফএল চালু হওয়াতে সেখানে দিতে হচ্ছে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আবাসিক খাতে মাত্র ১৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এ কারণে সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
মহানগরীতে গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা তিন লাখ ৬০ হাজারের বেশি। যার মধ্যে শিল্পকারখানায় রয়েছে ১৫০০। অন্যদিকে সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে ৬০টি। আবাসিক এলাকায় গ্যাসের চাহিদা সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বিদ্যুৎ, সার কারখানা, শিল্প, কেপটিভ পাওয়ার, বাণিজ্যিক, মৌসুমি, চা বাগান, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও আবাসিক এ নয় ধরনের গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে কেজিডিসিএল। চট্টগ্রাম মহানগরীতে গ্রাহকের সংখ্যা রয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি। নতুন বাসাবাড়ির বাইরেও চট্টগ্রামে গ্যাসের কয়েকটি বড় (বাল্ক) ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এদিকে গ্যাসের অভাবে এ অঞ্চলের গ্যাসনির্ভর সব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে বরাদ্দ গ্যাস সিইউএফএল সার কারখানায় সরবরাহ দেয়ায় এই সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাসনির্ভর ৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৬৩০ মেগাওয়াট। বন্ধ থাকায় ৬৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে বোরো ক্ষেতে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় রাউজান বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২টি ইউনিট, শিকলবাহায় ১৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট ও ৬০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২টি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে চট্টগ্রামে শিল্প-বাণিজ্যিক ও আবাসিক সব খাতে নতুন সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। গত এক মাস যাবৎ নগরীতে সরবরাহ লাইনে চাপ কমে যাওয়ায় আবাসিক গ্রাহকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গ্যাসনির্ভর কল-কারখানাগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
চট্টগ্রামে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর দৈনিক বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে অর্ধেকেরও কম। চট্টগ্রামের গ্যাসের বৃহৎ গ্রাহক হচ্ছে কাফকো ও সিইউএফএল। এই দু’টি কারখানায় দৈনিক ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কাফকোতে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট ও সিইউএফএলে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
গ্যাস সঙ্কটের কারণে সিএনজিচালিত যানবাহনগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফিলিং স্টেশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও পর্যাপ্ত গ্যাস মিলছে না। অটোরিকশা চালকেরা বলছেন, তিন ঘণ্টা লাইনে থেকে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে তিন ঘণ্টা চলছে না। এতে করে তাদের আয়ও কমে গেছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় সিএনজিচালিত যানবাহনে পর্যাপ্ত গ্যাস মিলছে না।
চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট নিরসনে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি করা হয় দীর্ঘদিন থেকে। তবে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চট্টগ্রামে চাহিদা থাকার পরও গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়নি বরং বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। সঙ্কট নিরসনে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ভাসমান এলএনজি গ্যাস টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। মহেশখালী থেকে আনোয়ারা হয়ে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ দিতে লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। মহেশখালীতে নির্মিতব্য এলএনজি গ্যাস টার্মিনাল থেকে ২০১৮ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ দেয়া যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর ততদিন পর্যন্ত গ্যাস সঙ্কট অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই।
- See more at: https://www.dailyinqilab.com/article/63191/%E0%A6%9A%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%B8%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%B0%E0%A6%AE-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD