২৩ মে ২০১৮, বুধবার, ১০:২৪

অরক্ষিত রাষ্ট্রীয় কোষাগা রিজার্ভ চুরির কূলকিনারা করতে পারেনি সরকার

বর্তমান সরকারের সময়ে আর্থিক শৃঙ্খলার বেহাল দশায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার এ জায়গা থেকেও অর্থ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি সময়ে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন (৮ কোটি ১০ লাখ) ডলার বাংলাদেশী টাকায় ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ফিলিপাইনের হ্যাকাররা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতার কারণে অল্পের জন্য রক্ষা পায় আরো প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ চুরি ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। শুধু দেশের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল না, আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও সংবাদের শিরোনাম হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এখনো পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ অর্থ চুরির সাথে যারা জড়িত তাদেরও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরাতে আজও পর্যন্ত কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি সরকার। রিজার্ভ চুরির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চক্র জড়িত আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ব্যাংকের ভিতরের লোক জড়িত না থাকলে এতো বড় ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।

বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ চুরির এই ঘটনাটি ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটলেও তা বাংলাদেশের মানুষ এক মাস পর ৫ মার্চ জানতে পারে। ৭ মার্চ থেকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপর ফিলিপাইনের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন তথ্য। ফিলিপাইনের দৈনিক পত্রিকা ইনকোয়ারার প্রতিবেদন অনুযায়ী- চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের রিজার্ভ ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার শাখায় ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে অর্থের বড় অংশ চলে যায় দেশটির ক্যাসিনোতে (জুয়ার আসরে)। আবার ক্যাসিনোতেও সেই অর্থ ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ আরও ২০ দিন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ কোটি ডলার সরাতে মোট ৩৫টি অনুরোধ পায় নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ। এর প্রথম চারটি অনুরোধে তারা ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ৮১ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করে। এরপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে ওই টাকার প্রায় অর্ধেক চলে যায় ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিলে। পঞ্চম আদেশে শ্রীলঙ্কায় প্যান এশিয়া ব্যাংকিং করপোরেশনে একটি ‘ভুয়া’ এনজিও’র অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
এ ঘটনায় গত বছরের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫)-এর ৪ ধারাসহ তথ্য ও প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৪ ধারায় ও ৩৭৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন।

অর্থ চুরি যাওয়ার বিষয়টি প্রায় এক মাস চেপে রাখায় সমালোচনার মধ্যে পড়েন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় ড. আতিউর রহমানের। ঘটনার এক মাস ৯ দিন পর দ্বিতীয় মেয়াদের পাঁচ মাস বাকি থাকতেই ১৭ মার্চ পদত্যাগ করেন তিনি। অব্যাহতি দেয়া হয় আরও দুইজন ডেপুটি গভর্নরকে।

এরপর ১৬ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাক্তন অর্থ সচিব ও সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি জানায়। ফজলে কবির বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হিসেবে ২০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগদান করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ফিলিপিন্সে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনাই তার এখন প্রধান কাজ।
পরে ১৫ মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ৭৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। কমিটি নির্ধারিত মেয়াদের আগেই অর্থমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট জমা দেয়।

কমিটি যে রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয় ওই রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি। ফিলিপাইন সরকারও ওই রিপোর্টটি চেয়েছে বাংলাদেশের কাছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাফ জানিয়ে দেন রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন ফিলিপাইনকে দেয়া হবে না। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একই বছর ২৬ নভেম্বর আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল যায় ফিলিপাইনে। কিন্তু তারা শূন্য হাতে ফিরে আসে।
এ দিকে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের তথ্য ফাঁসে বাংলাদেশ ব্যাংকে তোলপাড় শুরু হয়। এফবিআই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার রিজার্ভ চুরিতে ব্যাংকটির ভেতরকার ব্যক্তিদের যোগসাজশ ছিল। এফবিআইয়ের এজেন্টদের দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ তারা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এফবিআইয়ের বরাত দিয়ে এ তথ্য প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে মামলা করার পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়ার্ক ও আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সুইফটের সঙ্গে আলোচনা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলার বিষয়ে ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেয়নি। ওই মামলায় তারা বাদী হবে কি না, এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি। অর্থ উদ্ধারের জন্য ২০১৮ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ওই দেওয়ানি মামলাটি নিউইয়র্কে হওয়ার কথা থাকলেও এ বিষয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ও সুইফটের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফলে মামলা করার সে পরিকল্পনা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
আর্থিক কেলেঙ্কারির এ বিষয়টি এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সর্বশেষ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে আলোচনা চলছে। অর্থ চুরির পর থেকে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংককে টাকা ফেরতের ব্যাপারে বলা হয়েছে। প্রথমে তারা আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে গড়িমসি শুরু করে। তাই এখন শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে। রিজাল ব্যাংককে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে চাই।”
অর্থমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পর ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনায় নিজেদের গাফিলতির দায় এড়াতে তথ্য গোপন করে বাংলাদেশ ব্যাংক আরসিবিসিকে ‘বলির পাঁঠা’ বানাতে চাচ্ছে। ব্যাংকটি অভিযোগ করে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকটির এ ধরনের অভিযোগের খবর দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে রয়টার্স। ওই প্রতিবেদনে আরসিবিসির হেড অব লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স জর্জ ডেলা কুয়েস্তার বরাতে বলা হয়, আইনত যেসব তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব, আরসিবিসি তার সবই ফিলিপিন্সের সিনেট এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকই সবকিছু লুকিয়েছে। আরসিবিসির অভিযোগ নাকচ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে চুরি যাওয়া অর্থের সর্বসাকুল্যে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার হয়েছে বলে জানানো হয়। |

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশের অভ্যন্তরের একটি চক্র জড়িত থাকার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার প্রতিবেদন দাখিলের সময় ইতোমধ্যে ২৩ বার পিছানো হয়েছে। সর্বশেষ আগামী ৩ জুন প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছে আদালত। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন। রিজার্ভ চুরির এ ঘটনা দেশের মানুষের মনকে চরমভাবে ব্যথিত করে। সর্বক্ষেত্রে তৈরী হয় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি। সরকার এ চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে পারলে জনমনে কিছুটা স্বস্তি আসতো। কিন্তু সরকার তার কোনো কুল-কিনারা আজও করতে না পারায় মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো বড় অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে কোন মহল জড়িত? তারা কি এতোটাই শক্তিশালী যে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত প্রকাশ করা হচ্ছে না। আবার মামলার প্রতিবেদন দাখিল করতে বার বার কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। এটা দেশের আর্থিক শৃঙ্খলার চরম ঘাটতি নয় কী?

http://www.dailysangram.com/post/331415