কয়েক দশক পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচনকে সম্ভবত একটি ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লব’ হিসেবে স্মরণ করা হবে। কারণ, এই নির্বাচন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। গত ৯ মে ধাঁধা লাগানো নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গোটা বিশ্বকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। বিশ্ববাসী দেখল, ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ব্রেক্সিট ভোট এবং ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতোই বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক পরাজিত পক্ষ সামান্য ব্যবধানে জয়লাভ করবে বলে ভুল পূর্বাভাস দিয়েছিল।
ভোট গ্রহণের বুথগুলো বন্ধ করে দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সবার কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, অসম্ভব কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ৯২ বছর বয়সেও শক্তি, সামর্থ্য ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী মালয়েশিয়ার সাবেক স্ট্রংম্যানÑ মাহাথির মোহাম্মদ বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্দান্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেন। রোমাঞ্চকর আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সাথে মাহাথির প্রচণ্ড ও প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও সাহসের সঙ্গে তার মোকাবেলা করেছেন। সমালোচকেরা তার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা এবং কলঙ্ক আরোপের মাধ্যমে তার মানহানি করেছেন। তারা তার দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে ঠাট্টাবিদ্রƒপ করে দাবি করেন, তিনি এতই ‘বয়োবৃদ্ধ’ যে, তার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
মালয়েশিয়ার নবনির্বাচিত নেতা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধান একটি চুক্তির অংশ হিসেবে বিরোধী গ্রুপগুলো দেশকে একটি পরিচ্ছন্ন সরকারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক গতিশীলতার একটি নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন অন্তর্বর্তী নেতা হিসেবে মাহাথিরকে গ্রহণ করেছে।
গত শতাব্দী দেখেছে, মাহাথির অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল মালয়েশিয়া গড়ে তোলার জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এই শতাব্দী তাকে হয়তো এশিয়ায় একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে দেখবে। নির্বাচনে চূড়ান্ত বা সত্যিকারের বিজয়ী হচ্ছেন গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে সংগ্রামরত বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। একটি মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিনি কারাভোগ করেছেন। রাজকীয় ক্ষমা পাওয়ার পর পরই আনোয়ার মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ।
কয়েক দশকের নিষ্ফল কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির পর মালয়েশিয়া প্রায় রাতারাতি গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার একটি আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছে। অথচ অঞ্চলটি এখন ডানপন্থী জনাকীর্ণ এবং সামরিক সরকারগুলোর দ্বারা একটি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব
অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মালয়েশিয়ার সর্বশেষ নির্বাচনে দেশবাসী যে দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
বিভিন্নভাবে নির্বাচনী ফলাফল সরকার পরিবর্তনেরই সমার্থক । আর মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় কোয়ালিশন পাকাতান হারাপান বারিসান নাশিওনাল (বিএন) বা ক্ষমতাসীন জোটকে পরাজিত করে তাদের ছয় দশকের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়েছে।
মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে এই প্রথম এক পার্টির হাত থেকে অপর পার্টি বা জোটের হাতে সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। এটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ব্যাপক দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি সত্ত্বে¡ও বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং তার সহযোগীরা ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে বেপরোয়া ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং তার সহযোগীদের হয়তো জেলে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে দেখা যাবে। নাজিব এবং তার দল বা গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিলের (১ এমডিবি হিসেবে পরিচিত) ১০০ কোটি ডলার লুটের জন্য অভিযুক্ত করা হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সারা বিশ্বের সরকারগুলো ১ এমডিবি তহবিলের সাথে সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলো তল্লাশি করবে অথবা বন্ধ করে দেবে।
নাজিব রাজাকের প্রশাসন জবাবদিহিতা ও সংস্কারের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। গত দুই বছরে নাজিব তার সমালোচকদের নিষ্ঠুরভাবে সরকার থেকে বের করে দিয়েছেন। যেকোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অভ্যুত্থান থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে দল ও সরকার থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তিনি ১ এমডিবি দুর্নীতির কেলেঙ্কারি তদন্তে নিয়োজিত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বহিষ্কার করেছিলেন। তার ব্যাংক হিসাব থেকে কোটি কোটি ডলার চুরি হয়ে যাওয়াসংক্রান্ত কনফিডেন্সিয়াল পেপার্সের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তিনি আকস্মিকভাবে দাবি করেন, এসব অর্থ সৌদি রাজপরিবার থেকে তাকে উপহার দেয়া হয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শাসক শ্রেণীর ব্যাপক, স্পষ্ট ও সরাসরি দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার বেদনাদায়ক দৃশ্য দেখতে দেখতে অসুস্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
একজন জাতির পিতা
নাজিব রাজাকের দীর্ঘ দিনের গুরু মাহাথির মোহাম্মদ বিরোধী দলে যোগ দেয়ার পর মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক সুনামি সংঘটিত হয়েছে। দীর্ঘ দুই দশক ধরে মাহাথির লৌহমানবের মতো মালয়েশিয়া শাসন করেছেন। সে সময় তিনি মিডিয়াকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ, তার সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমসহ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারারুদ্ধ এবং অতিশয় কঠোর আইন প্রণয়ন তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ওইসব আইনের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন বা একঘরে করে রাখা হয়। এসব সংখ্যালঘুর মধ্যে রয়েছে চীনা ও ভারতীয়। এসব আইনের মাধ্যমে উদারপন্থী ও বুদ্ধিজীবীদের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল।
তিনি কথিত ‘এশীয় মূল্যবোধের’ পেছনে একটি লিডিং ভয়েসে পরিণত হন। কিন্তু মাহাথির মালয়েশিয়াকে উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। তিনি বিশ্বমানের অবকাঠামো গড়ে তোলেন এবং একটি ‘বুমিং মিডল ক্লাস’ হিসেবে মালয়েশিয়াকে গড়ে তোলেন।
এই প্রশংসনীয় যোগ্যতার কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মন-মানসিকতাকে তিনি জয় করে নিলেন। ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর তিনি দ্রুত কিং থেকে কিংমেকারে পরিণত হন। তার দু’জন উত্তরসূরি আবদুল্লাহ আহমদ বাদাবি এবং নাজিব রাজাকের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। নাজিব অবশ্য ২০১৩ সালেই তার কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি হারান। কিন্তু অন্যায় প্রভাব বিস্তার, ভোটারদের রাজনৈতিক সুবিধা দান, বিরোধী গণমাধ্যমকে পরিকল্পিতভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং তার অনুকূল গ্রামীণ সংসদীয় আসনগুলোর জনগোষ্ঠীকে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখেন।
আনোয়ারের নেতৃত্বে বিরোধী দল পপুলার ভোটে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু তারা পার্লামেন্টে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করা থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয়। এবার মাহাথির গ্রামীণ মালয়ীদের ক্ষমতাসীন পার্টি থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি সেখানে ক্ষমতাসীন পার্টির মালয়ভিত্তিতে ভাঙন ধরালেন। অপর দিকে, মাহাথির তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে অধিকসংখ্যক শহুরে এবং গোষ্ঠীগত বিভিন্ন বিরোধী গ্রুপকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন।
যাই হোক না কেন, সামনের পথচলা হবে চ্যালেঞ্জিং। মাহাথির চুরি যাওয়া রাষ্ট্রীয় তহবিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত আনা, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা এবং এমনকি চীনের সাথে স্বাক্ষরিত প্রধান অবকাঠামো চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উল্লেখ্য, নাজিব রাজাকের আমলে চীন মালয়েশিয়ায় ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে।
সরকার পরিচালনায় সামনে অগ্রসর হয়ে মাহাথিরকে বিচার বিভাগ এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাকে সংস্কার করতে হবে। জুডিশিয়ারি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সার্ভিস এখনো আগের সরকারের জনবল দ্বারা ভারাক্রান্ত। রাষ্ট্রীয় এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার না করলে নতুন সরকারের যেকোনো দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ আয়োজনÑ রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকেই বুমেরাং হতে পারে।
মালয়েশিয়ার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। এ কাজটির ভার মাহাথিরের উত্তরসূরি আনোয়ার ইব্রাহিম এবং দেশের প্রগতিশীল নতুন প্রজন্ম ও তরুণ নেতৃত্বের ওপর গিয়ে পড়বে। এখন আকাশে-বাতাসে চতুর্দিকে আশার আলো। সাবেক স্ট্রংম্যানের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা স্ববিরোধী হলেও সত্য বর্জিত নয়Ñ তবুও চূড়ান্তভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন এসেছে। কয়েক দশক পর মালয়েশিয়ার ১৪তম সাধারণ নির্বাচনকে সম্ভবত একটি শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসেবে স্মরণ করা হবে। সে বিপ্লব দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির ইতিহাস বদলে দিয়েছে।