১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৮

ঋণনির্ভরতা বাড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে: ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতিই দায়ী

ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য। কারণ রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি দেশকে ঋণ নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে এটি ধরা পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বৈদেশিক লেনদেনের আদান-প্রদান (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) সংক্রান্ত হিসাবে ৭৯ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার ঘাটতির কথা বলা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
অর্থনীতিবিদের মতে, কোনো দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাবে যদি উদ্বৃত্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিয়মিত লেনদেনের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে কোনো ঋণ করতে হয় না। একইভাবে আয়-ব্যয়ের এই চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে অর্থাৎ আমদানি ব্যয়ের বাড়তি চাহিদাজানিত অর্থের যোগান দিতে সরকারকে ঋণ করতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন সে পরিস্থিতির দিকেই যাচ্ছে। কারণ গত কয়েক মাস ধরেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। কিন্তু যে হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে সে হারে রফতানি আয় আসছে না। মূলত এ কারণেই বৈদেশিক লেনদেনের হিসাবে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
সরকারের দাবি দেশে পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলসহ বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। এ জন্যে নির্মান সামগ্রীর আমদানিও অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া জ্বালানি তেলসহ অন্যান্যখাতে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। বেড়েছে শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রবণতা। পাশাপাশি দেশে খাদ্যপণ্য গম ও চাল আমদানিও বেড়েছে। এসবের প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক আমদানির উপর। এদিকে বিষয়টি সত্য হলেও এর প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও দেশের লেনদেন ভারসাম্যের উপর। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বেশ কিছু দিন ধরে বড় উদ্বৃত্ত ছিল, যা এখন ঘাটতি পর্যায়ে রয়েছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, দেশে এখন কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। সেসব প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি করতে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রকল্পের দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে বাজেট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। একইভাবে আইআরসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী বেসরকারি পর্যায়ে শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি কেনার হারও বেড়েছে। এ কারণে বাণিজ্য ঘাটতি সাময়িক একটু বেশি হতে পারে। তবে আমি মনে করি এই নিয়ে শংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অন্যদিকে রফতানি আয় সেভাবে না বাড়ার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, রফতানি খাতের প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। মোট রফতানি আয়ে ৮৮ শতাংশই এ খাত থেকে এসে থাকে। কিন্তু নানা বাস্তবতার কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতের স্বাভাবিক পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের তৈরি পোশাকের মার্কেটিং অর্ডার, নেগোসিয়েশন, কোয়ালিটি চেক ও মেইনটেন্যান্স এসব ক্ষেত্রে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি ব্রেক্সিট ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের মত ভূ-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণেও বাংলাদেশের রফতানি আয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ক্রয় এবং চাহিদা দু’টোই কমে গেছে। এর বাইরে রফতানি পণ্যের মূল্য হ্রাস, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বিদেশী ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কমপ্লায়েন্স শর্ত পালনে অতিরিক্ত খরচের কারণে উদ্যোক্তার সক্ষমতাকে শুন্যের কোটায় নেমে আসাও এর নেপথ্য কারণ বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলেছেন, গত দুই-আড়াই বছরে আমদানি খাতে ব্যয় কম ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকা। এ কারণে সে সময় আমদানি করেও বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য একটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারও অস্থিতিশীল হতে থাকায় এর প্রভাব পড়েছে দেশের আমদানিখাতে। সর্বশেষ সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৩০ মার্কিন ডলার। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে সেটি প্রায় ৬০ ডলারে স্পর্শ করার অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থাৎ দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দিন দিন বড় হচ্ছে।
http://www.jugantor.com/industry-trade/2017/02/14/101064/%E0%A6%8B%E0%A6%A3%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A6%BF%E0%A6%9C