১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২০

সড়ক দুর্ঘটনা: বছরে আর্থিক ক্ষতি ৩৪ হাজার কোটি টাকা

সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটি শুধু পরিমাপযোগ্য ক্ষতি। এর বাইরে রয়েছে মানুষের প্রাণহানির ক্ষতি, যা পরিমাপ করা যায় না। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিও বাড়ছে।
সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে আড়াই হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এ সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি। মূলত গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে দুই হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক ডিজিটাল ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বিভিন্ন দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা হয় মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির শতাংশ ধরে। উন্নয়নশীল দেশে এ ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ৩ শতাংশ। এ দেশে ক্ষতি হয় জিডিপির ২ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপি ১৭ লাখ কোটি টাকা। তার ২ শতাংশের পরিমান ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘বছরে বিভিন্ন থানার মামলার ভিত্তিতে আমরা দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করি। দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ দুর্ঘটনার তথ্যই মাঠপর্যায়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। ফলে প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। ’
২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরি বাংলাদেশে ২০০২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছিল। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার, সম্পত্তি, চিকিৎসা ব্যয়, আইনি ব্যয়ের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়েছিল।
একই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৬ সালের সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ ধরেছিল পাঁচ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এসংক্রান্ত প্রতিবেদনে ব্যক্তির ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৭ শতাংশ, চিকিৎসা ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে ৩ শতাংশ, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের ক্ষতি ধরা হয়েছিল ৩৪ শতাংশ, যানবাহনের ক্ষতি ধরা হয়েছিল ৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ বা ভয়াবহতা নির্ভর করে গাড়ির গতির ওপর। এ দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়। এসব মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চালানো হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগে। ফলে প্রাণহানি ও সম্পদহানি বেশি হচ্ছে।
জাতিসংঘের নির্দেশিত লক্ষ্য অনুসারে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সড়ক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৫ শতাংশ সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য খরচ করলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ববরণের হার কমবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ঝুঁকি: সরকারি হিসাবে, বছরে সড়কে দুই থেকে আড়াই হাজার প্রাণ ঝরে যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এ সংখ্যা ২১ হাজার। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে সড়কে বছরে প্রাণ যায় ১২ হাজার মানুষের।
সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দেখতে পেয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১৯১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপ—জিআরএসপির তথ্যানুসারে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মোটরগাড়ি ৪০ শতাংশ কম হলেও সড়কে প্রাণহানি ঘটে গড়ে ৮৬ শতাংশ।
ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরির হিসাবে, প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে দুর্ঘটনার ঝুঁকির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম অবস্থানে ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ঝুঁকির শীর্ষে। বাংলাদেশ নেপালের স্থানটি দখল করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যৌথভাবে ডিজিটাল তদারকি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে। দুই হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক ৪০টি অংশে ভাগ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তদারক করা হবে। এ জন্য ২৪ ঘণ্টা সচল থাকবে স্পিড এনফোর্সমেন্ট ক্যামেরা। মহাসড়ক পুলিশ ও মহাসড়কের কাছে ১২০টি ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা এ কাজে সহায়তা করবেন।
কিছু ঘটনার কথা: গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর পান্থপথে প্রাইভেট কারের দরজার ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালকের সহযাত্রী রতীশ দাস গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ডান পা ও কোমরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রতীশ রাজধানীর কাজীপাড়ার বাসায় দিনরাত কাটান বিছানায়। একটি ইন্স্যুরেন্স কম্পানির কর্মকর্তা রতীশের স্ত্রী অনিমা পুরকায়স্থ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ব্র্যাকের চাকরি ছেড়েছেন। ছেলে অভিবাদন দাস নবম শ্রেণিতে পড়ে। রতীশের দুর্ঘটনার পর থেকে সংসারে অনিমা আর অভিবাদনের মনে দানা বেঁধেছে অনিশ্চয়তা। অনিমার মতে, এ ক্ষতি টাকার অঙ্কে হিসাব করা যাবে না।
নড়াইল থেকে আমাদের প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম তুহিন জানান, ১৯৯৩ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পাটেশ্বরী গ্রামের আলমগীর। ১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। পাঁচ ভাই আর ছয় বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় পরিবারের অন্য ভাই-বোনদের অভিভাবক হিসেবে অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়াও সব ধরনের পরামর্শ দিতে হতো তাঁকে। টেক্সটাইল টেকনিক্যাল কাজ জানা থাকায় চাকরির সংকট হয়নি তাঁর। সবশেষ চাকরি করেন ঢাকার বাইপাইলের সিএমসি কামাল টেক্সটাইল মিলে মেইনটেন্যান্স অফিসার পদে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করা এই ব্যক্তি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ আয় করতেন ৪০ হাজার টাকা। নিজের সঞ্চিত অর্থে নড়াইল শহরতলি এলাকার বরাশুলা চরপাড়ায় সাত শতক জমি কিনে একটি টিনের ঘর বানিয়েছিলেন। বেশ সচ্ছলভাবেই সংসার চলছিল আলমগীরের। পাঁচ বছর আগে শহরে বাড়ি করে পরিবারের সদস্যদের সেখানে নিয়ে যান গ্রাম থেকে। ছেলেকে ভর্তি করান নড়াইল সরকারি উচ্চ বিদ্যলয়ে। স্ত্রী সালমা সুলতানা বলেন, ‘ভাই, আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ছেলেমেয়েকে কিভাবে খাওয়াব সেই চিন্তায় আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ’
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশির ভাগই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। প্রতিদিন বহু পরিবারে এ অন্ধকার নামছে।
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক, বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘পরিমাণ করা যায়, এমন ক্ষতির হিসাব করা যায়। কিন্তু একজনের চলে যাওয়ার বিষয়টিকে টাকার অঙ্কে ফেলা যায় না। এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনার ক্ষতি অসীম। ’
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/13/463060