১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৩৮

বেড়েছে কিশোর অপরাধ বদলেছে ধরণ

‘ভিডিও গেমে গ্রুপ বানিয়ে মারামারি করছে। হার-জিত নিয়ে উত্তেজিত হচ্ছে। টেলিভিশনে বিদেশি সিরিয়ালগুলো অপরাধের কৌশল দেখাচ্ছে- এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের কিশোররা বখে যাচ্ছে। তারাও তৈরি করছে গ্যাং বা গ্রুপ। মতের মিল না হলে খুন করে ফেলছে সহপাঠীকেই। যেটা আমাদের জন্য খুবই ভয়ঙ্কর। পারিবারিক সচেতনতা, ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকেও পড়াশোনা দরকার। না হলে সামনে যে প্রজন্মটা আসছে তাতে পারিবারিক বন্ধন বলে কিছুই থাকবে না। এখনই ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে পারিবারিক বন্ধন।’ ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে কিশোরদের নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের প্রজন্মে শিশু বা কিশোররা খেলাধুলা করতে মাঠে গিয়ে মারামারি করত। সেখানেও যে খুন হতো না তা নয়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা খেলার মাঠে যায় না। ঘরের মধ্যে বসে বা দোকানে গিয়ে ভিডিও গেম খেলে। কম্পিউটার বা নোটবুক নিয়ে সারাদিন ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে। ফলে তাদের মধ্যে সহনশীলতা একেবারেই কমে যাচ্ছে। অল্প বয়সেই তারা হিংস্র হয়ে উঠছে। কোনো ধরনের বিরোধিতাই তারা সহ্য করতে পারে না। এই শিশু-কিশোররাই গ্রুপ তৈরি করে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কেউ তাদের কাজে বিরোধিতা করলে তাকে তারা খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘তিনটি কারণে কিশোররা বখে যাচ্ছে। এক. পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। দুই. আকাশ সংস্কৃতি। এবং তিন. মিডিয়ায় দেখানো নৃসংশতা। যেটা বাংলা সিনেমায় দেখানো হয়। হিন্দি সিরিয়ালেও এসব দৃশ্য দেখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চাওয়া পাওয়া থেকে কিশোরদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। চাওয়া-পাওয়ার মিল না হলে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। তাতে করে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।’

মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ফাঁক-ফোকর রয়েছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে অপরাধের ধরনও তত বদলাচ্ছে। আগে ছিল পরিকল্পিত, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে আমার মনে হয়, তথ্য প্রযুক্তির কারণে তাদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে। তারা প্রযুক্তি দেখে সেটার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আর উত্তরায় যে ঘটনা ঘটেছে তাতে দেখা যায়, এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। মাদকাসক্ত। ফলে এদের মধ্যে নিষ্ঠুরতা বেশি। তারা যা ইচ্ছে, তাই করছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (শিশু বিষয়ক মানসিক রোগ বিভাগ) ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন ইত্তেফাককে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা দেখছি কিশোর অপরাধের ধরন বদলে গেছে। আমাদের কাছেও এমন রোগী আসছে। এর মূল কারণ হিসেবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভিডিও গেম, ইন্টারনেট এবং টিভি সিরিয়াল। আগের মতো এখন শিশুরা খেলার মাঠে যায় না। ঘরের মধ্যেই তারা ইন্টারনেটে বিশ্ব দেখছে। অপরাধের কৌশল দেখছে। এক ধরনের হিরোইজম তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে যাচ্ছে। এর জন্য আরবান সংস্কৃতি বহুলাংশে দায়ী। এর জন্য এখনই প্রতিকারের ব্যবস্থা করা দরকার।’

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন ইত্তেফাককে বলেন, ‘কিশোরদের মধ্যে একটা অনুসরণ করার প্রবণতা থাকে। এই বয়সে তাদের মনে একটা অ্যাডভেঞ্চর কাজ করে। তারা যে কাজ করে আনন্দ পায় তা দ্রুত অনুসরণ করে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেলে তা কিশোরদের খুব দ্রুত অপরাধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই কিশোর বয়সে অপরাধ করলেও আইনে তাদের শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই। তাদেরকে সংশোধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। অভিভাবকদের এখন সচেতন হতে হবে।’

গত ৬ জানুয়ারি উত্তরায় কিশোর গ্রুপের হাতে প্রতিপক্ষ গ্রুপের স্কুল শিক্ষার্থী আদনান কবির খুনের ঘটনায় বেরিয়ে এসেছে কিশোরদের বিভিন্ন গ্রুপ বা গ্যাং কেন্দ্রিক অপরাধের ভয়ঙ্কর চিত্র। বিভিন্ন নামে এরা এই গ্রুপগুলো বানিয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্ধ্যার পর কিশোররা কেন বাড়ির বাইরে থাকে-সেটির খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব অভিভাবকদের। অভিভাবকরা প্রয়োজন ছাড়া টাকা-পয়সা তাদের কিশোর সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে আরো বিপদগামী করছে। এক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধনটা আরো সুদৃঢ় করাতে হবে।’
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2017/02/10/175058.html