১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৩৮

শতবছর আগের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় বৃত্তান্ত

|| সাজজাদ হোসাইন খান || পুস্তকটির দ্বিতীয় সংস্করণ হয়েছিল ১৮৩১ শকাব্দে। প্রথম সংস্করণ এর দু’এক বছর আগে হয়তো হবে। প্রবেশ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘পরীক্ষা’। তার নিচে ‘বিদ্যালয় পাঠ্য সাহিত্য পুস্তক’ বাক্যটি। শ্রীযোগীন্দ্র চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংকলিত। আলবার্ট লাইব্রেরী, ঢাকা, নবাবপুর, নারায়ণ প্রেসে, শ্রী রাধা বল্লভ বসাক দ্বারা মুদ্রিত। বর্তমান শকাব্দ ১৯৩৮। সে হিসেবে ইংরেজি সন হবে ১৯০৯ কি ১৯১০, অর্থাৎ প্রায় একশ আট বছর আগে এই পুস্তকটি বিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তৎকালীন ভদ্র এবং শিক্ষিত সমাজ তাদের সন্তানদের জন্য ‘পরীক্ষা’ নামক পুস্তকটি সাব্যস্ত করেছিলেন। পুস্তকে সংকলিত বিষয় আশয় বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বালক-বালিকাদের জ্ঞান-মেধা স্বভাব-চরিত্র যে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছাবে না তাতে তাদের সন্দেহের কোনো উদ্রেক হয়নি। তাই পাঠ্য তালিকায় ‘পরীক্ষা’ নামের পুস্তকটি সাদরে গৃহীত হয়ে, পঠিত হয়। পুস্তকটি কোন্ শ্রেণিতে পাঠ্য করতে হবে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা নাই ছাপার হরফে। তবে পুস্তকের প্রথম পাতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা স্কুলের দু’জন ছাত্রের নাম লেখা রয়েছে। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় কোথাও কোথাও কালি অস্পষ্ট। একজন প্রফুল্ল চৌধুরী না চন্দ্র বোঝা যাচ্ছে না। অন্যজন বিজয় চন্দ্র ভট্টাচার্য শ্রেণির জায়গায় কালি লেপটে আছে। তৃতীয় পৃষ্ঠার লেখাটি স্পষ্ট। বিনয় রঞ্জন সেন, ক্লাস এইট, জিলাস্কুল, ১৯১১। স্থান উল্লেখ না থাকায় এটি কুমিল্লা জেলাস্কুল কিনা বলা যাচ্ছে না। আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে ‘পরীক্ষা’ নামের পুস্তকটির সন্ধান পাই। তাও আজ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে। আমার দাদাগণ ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা স্কুলের ছাত্র। স্মরণযোগ্য দাদার বড়ভাই ইতিহাসবিদ মৌলভী আবদুল লতিফ খান ছিলেন অন্নদা স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক, ১৯২১ সালের দিকে। সেই যোগসূত্রেই পুস্তকটি আমাদের বাড়ির পাঠাগারে পৌঁছে যেতে পারে। শেষাবধি আমার হস্তগত হয় ‘পরীক্ষা’।
এক সময় মদন মোহন তর্কালঙ্কার এর ‘বাল্যশিক্ষা’ অথবা রামসুন্দর বসাক এর ‘আদর্শ লিপি’ ছিল অবশ্য পাঠ্য তালিকায় শিশুদের জন্যে। অক্ষর জ্ঞানে প্রথম প্রবেশের সাথে সাথে শুরুর পাঠ ছিল এ দু’টি বই। শিশুরা জীবনের পথপরিক্রমায় শিখে নিত বিনয়, শৃঙ্খলা, মমতা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, সত্যকে সত্য বলার জ্ঞান, মিথ্যাকে মিথ্যা বলার জ্ঞান। অক্ষর চিনতে চিনতে শিশুগণকে মানবিক জ্ঞানেও উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকতো সেসব বইয়ে। বইগুলো সেভাবেই বিন্যস্ত ছিল। সংকলকগণ বা রচয়িতাগণ শিশু মন-মানসিকতার দিকে সূক্ষ্ম নজর রাখতেন। সেজন্য শিশুরা সেসব বই অধ্যয়নে সুমানুষ হিসেবে গড়ে উঠতো পরবর্তী জীবনে। মাতা-পিতা এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করতো। জ্ঞান আহরণের আঁতুরঘরই হলো পাঠ্যপুস্তক। তাই পাঠ্যপুস্তক যদি পাঠযোগ্য না হয়, সব রকম আবিলতামুক্ত না থাকে তবেই বিপদ। এই বিপদের দায় বহন করতে হয় পিতা-মাতা, দেশ ও জাতিকে শেষাবধি। ভালো বই যেমন সুপথকে প্রশস্ত করে মন্দ বই তেমনি কুপথকে করে অবারিত। যেজন্যে পাঠ্যপুস্তক রচনায় সাবধানতা প্রয়োজন, প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা। বিশেষ করে বিদ্যালয় উপযোগী বই রচনার বেলায়। ‘বাল্যশিক্ষা’ বা ‘আদর্শলিপি’। পুস্তক দু’টি এখনো পাঠ্যপুস্তক হিসেবে শিশুদের জন্য উদাহরণরূপে উজ্জ্বল। আধুনিক যুগে প্রকাশনায় চাকচিক্য এসেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের। কিন্তু মানুষকে যথার্থ মানুষ হয়ে গড়ে উঠার তেমন কি নতুন পাঠ আবিষ্কৃত হয়েছে? সততা, শৃঙ্খলা, বিনয়, প্রণতি এবং সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির আদিতে যা ছিল এর তো কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি এখনো, উপস্থাপনায় হেরফের হয়ে থাকবে হয়তো। তবে উচ্ছৃঙ্খলা, বিশৃঙ্খলা, অসততা এবং অবিশ্বাসের শাখা-প্রশাখা শতরূপে আবির্ভূত হয়েছে, হচ্ছে ইদানীং। এগুলোর প্রয়োগও চলছে নানাভাবে, নব নব কৌশলে। মিথ্যার মোড়কে সত্য অসভ্যতাকে হাজির করা হচ্ছে শোভনতার পোশাক-আশাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতেও তেমনি জোচ্চুরির বাইরে থাকছে না। তাই সতর্কতা দরকার, শিশুদের কাছে জ্ঞান বিতরণের বেলায়। জ্ঞান বিতরণের প্রথম কপাটটি খুলতে হয় পাঠ্যপুস্তকে। পাঠ্যপুস্তক যত শোভন হবে সুশৃঙ্খল হবে যত সত্য সন্ধ হবে ততই মঙ্গল শিশু-কিশোরদের জন্য। তেমনি মঙ্গল দেশ ও জাতির জন্য। কারণ এই বিদ্যার্থীগণই আগামীদিনের নাগরিক ভবিষ্যৎ। তাই ভবিষ্যতের মঙ্গল চিন্তা করেই প্রয়োজন উৎকৃষ্ট পাঠ্যবই।
‘পরীক্ষা’ অষ্টম শ্রেণির বিদ্যালয় পাঠ্য একটি পুস্তক। যা শতবছর আগেকার। তখন ইংরেজ আমল। আবারো উল্লেখ করছি সংকলকের নাম শ্রী যোগীন্দ্রচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পুস্তকটির এটি দ্বিতীয় সংস্করণ। সংকলকের পরিচয় জানা না গেলেও প্রতীয়মান হয় তিনি ঢাকা এলাকার লোক ছিলেন হয়তো বা। সংকলনে স্থান পাওয়া লেখাসমূহের দিকে মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় সংকলকের মানসিক সুস্থতা এবং দৃষ্টির প্রখরতা কতটা সূক্ষ্ম ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গল ভাবনা, কল্যাণ কামনায় সংকলক ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। ‘পরীক্ষা’র প্রতিটি লেখাতে এ রকম মনোভঙ্গিরই প্রকাশ। শুরুর রচনাটির শিরোনাম ‘জগদীশ্বরের মহিমা কীর্ত্তন, বিদ্যারস্তব/রাজনারায়ণ বসু। এ লেখাটি মূলত বইয়ের ভূমিকা স্বরূপ বিন্যস্ত হয়েছে। এরপর ‘প্রবন্ধাবলী’র তালিকায় রয়েছে হযরত মোহাম্মদ/ধর্ম্মাচার্য গিরিশচন্দ্র সেন, সক্রেটিসের দোষ খ-ন/ অক্ষয় কুমার দত্ত, তপোবন/ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মন্বন্তর/বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাম্য, স্ত্রী-পুরুষ/বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জল সংস্কার/কেশবচন্দ্র সেন, মহত্ব/কালীপ্রসন্ন ঘোষ, প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে স্ত্রীলোকগণের সম্মান/প্যারী চাঁদ মিত্র, আর্য-কবি কল্পিত নারী চরিত্র/হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কথাবার্তা/দীনবন্ধু মিত্র, শ্মশানে/চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, অর্থ সঞ্চয়/ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সমগ্র ভারত/অক্ষয়চন্দ্র সরকার, স্বভাবজাত এবং পৌরষজাত চরিত্র/শিবনাথ শাস্ত্রী, সভ্যতা/রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, মশান প্রবেশ/চিরঞ্জীব শর্ম্মা, অধীনভাবে স্বাধীন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর্য জাতির আদিম অবস্থা/রমেশ চন্দ্র দত্ত, ভব্যতা ও শিষ্টাচার/রামকমল ভট্টাচার্য, দেশভেদে উদ্ভিদভেদ/রাজেন্দ্র লাল মিত্র, শ্রদ্ধা/মহাভারত, পিতৃব্রত/রামায়ণ, নেতৃবর আবুবকর, মহাত্মা ওমর, বিশ্বাসী আলী, আমীর ওসমান, এমাম হসন ও হোসয়ন, সাদি, এসলামনীতি : কৃতজ্ঞতা, প্রকৃত সাধু, বিনয়, ধনী ও দরিদ্র, স্বাস্থ্য, আত্মনির্ভর। পদ্যের তালিকায় আছে ষোলজন কবির লেখা-প্রকৃতি/মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, স্বভাব/হাফেজ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, নীলগিরি, কন্যাকুমারী/গোবিন্দদাসের কড়চা, যৌবনাশ্বপুরী/গঙ্গা দাসের আদি ও অশ্বমেদ পর্ব, অশোকতরু/হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝড়/ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কালী কীর্ত্তন/ রামপ্রসাদ সেন, মহাদেবের ভৈরবচিত্র/ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ/ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর, কালকেতুর সঙ্গে কলিঙ্গাধিপের যুদ্ধ মাধবাচার্য্যরে চ-ী, সীতা ও সরমা/মাইকেল মধুসূদন দত্ত, চিত্তশুদ্ধি প্রাধান্য, ঊষা/রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামকে রাক্ষসযুদ্ধে প্রেরণ/কৃত্তিবাস, বিরিঞ্চিনন্দন/কবিকঙ্কন চ-ী, রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রবেশ/নবীনচন্দ্র দাসের রঘুবংশ।
‘পরীক্ষা’র সংকলিত লেখাগুলোর দিকে নজর দিলেই বোঝা যায় সংকলকের মানসিক উদারতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতা কত স্বচ্ছ এবং পুষ্ট। একজন শিক্ষার্থীর জন্য কি জাতীয় বিদ্যা প্রয়োজন সব ধরনের পাঠক্রমই এই পুস্তকটিতে সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। বিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় থেকেই জ্ঞানের ব্যাপ্তি ঘটে। সুশিক্ষা পরবর্তী জীবনকে মহীয়ান করে। অন্যদিকে কুশিক্ষা বা বিভ্রান্ত চিন্তা অস্বস্তির কারণ হয়। পরিবার এবং সমাজকে করে কলুষিত। চলার পথকে করে অন্ধকারাচ্ছন্ন। শ্রী যোগীন্দ্রচন্দ্র, শুরুতেই শিক্ষার্থীদের যে জ্ঞানটি দিতে চেয়েছেন তা হলো ‘জগদীশ্বরের মহীমা কীর্ত্তন?’ লেখাটির সবশেষে বলা হচ্ছে “সকল বিদ্যা সমস্বরে সেই বিশ্বাধিপের অনন্ত মহিমা চিরকাল ঘোষণা করিয়া আসিতেছে এবং চিরকাল ঘোষণা করিতে থাকিবে। সমস্ত বিদ্যার ইহাই প্রধান গৌরব যে তাহারা ঈশ্বরের গুণগান করে।”
ইদানীংকালের প-িতপ্রবরগণ হয়তো বলবেন এসব তো সাম্প্রদায়িক চিন্তা। মৌলবাদী চিন্তা। শিক্ষাকে ‘হেজাবীকরণের’ চেষ্টা, কেউ বলবেন ‘অশনিসঙ্কেত’। কেউ বলবেন ব্যাগডেটেড চিন্তা। বলতে দ্বিধা নেই, এ রকম ব্যাগডেটেড চিন্তার বিদ্যাশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই কিন্তু জন্ম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শহীদুল্লাহর মতো বহু ভাষাবিদ। এ বছরের বিদ্যালয় পাঠ্য বিশেষ করে শিশু শ্রেণির বাংলা বই নিয়ে হৈ হল্লা শুরু করেছেন দু’চারজন। আসলে এমনটা মোটেও সুভাবনার ফল নয়। তাছাড়া দু’চারজন কথিত প-িতই দেশ বা জাতির চিন্তা-ভাবনাকে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখেন না। গণতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ মানুষের চিন্তা-ভাবনা গ্রহণযোগ্যের তালিকায় উঠে আসে, মান্য করে। শত বছর আগের পাঠ্য পুস্তক যে রকম চিন্তা-চেতনা ধারণ করতো ইদানীংকার পাঠ্যপুস্তক কিন্তু তেমনটা দৃঢ়চিত্ত নয়। সময়ের পালাবদলের কারণেই হয়তো এমন শৈথিল্য এসেছে। সে সময়ের অভিভাবকরা সন্তানদের সুভবিষ্যতের কথা ভাবতেন। তাই বিদ্যাশিক্ষা দেবার সময়ও সুবিদ্যা এবং সুশিক্ষার প্রতি ঝুঁকতেন। পাঠ্যবই বাছাইয়ের সময় এমন বিবেচনাকেই তুল্যমূল্যে দাঁড় করাতেন। যে জন্য ‘পরীক্ষা’র মতো সুচিন্তাপ্রসূত পাঠ্যপুস্তক গ্রহণযোগ্যের তালিকায় স্থান পেত। সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে হলে চাই সুবিদ্যা-সুশিক্ষা। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকায় আসতে পারে সুবিন্যস্ত পাঠ্যপুস্তক। সাম্প্রদায়িকতা বা অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাকার বাচনভঙ্গিকে পরিহার করে ‘সর্বশক্তিমান’ প্রণতি জানিয়ে শুরু হবে যে শিক্ষার পথচলা।
http://www.dailysangram.com/post/271223-%E0%A6%B6%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4