২ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ১০:৩২

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিজ্ঞাপন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে

তিন শিক্ষাবর্ষে ঝরে পড়েছে সাড়ে ৭ লাখ শিক্ষার্থী

শুধু প্রাথমিক বা মাধ্যমিকেই নয়, উচ্চমাধ্যমিকেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার থামছে না। উচ্চমাধ্যমিকে গত তিনটি শিক্ষাবর্ষের প্রতিটিতেই গড়ে আড়াই লক্ষাধিক করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। গত তিন শিক্ষাবর্ষে সাড়ে সাত লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষার বাইরে চলে গেছে বা ঝরে পড়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার প্রায় ২০ শতাংশ সরকারই স্বীকার করে থাকে।
ঝরে পড়াদের কত শতাংশ আবার শিক্ষায় যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে, তারও কোনো পরিসংখ্যান নেই শিক্ষা বোর্ডগুলোর কাছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃবোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মুহাম্মদ জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, বোর্ডওয়ারী কোনো পরিসংখ্যান নেই। যারা এ বছর অংশ নিচ্ছে না, পরের বছর তাদের অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে অংশ না নেয়াদের কত অংশ পরের বছর পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তারও কোনো সঠিক সংখ্যা নেই তাদের হাতে। তিনি বলেন, মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিকের আগেই মেয়েদের বিয়ে ও নিরাপত্তার অভাবে উচ্চমাধ্যমিকে আর ভর্তি হয় না। ভর্তি হলেও পরীক্ষা পর্যন্ত তারা টিকে থাকে না। এর জন্য সামাজিক ও নানা কারণ দায়ী। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা জরুরি।

ঝরে পড়া রোধে সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত তিন বছরের পরিসংখ্যান খুবই হতাশাজনক। আন্তঃবোর্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ১২ লাখ দুই হাজার ৬১৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ৯ লাখ ৬১ হাজার ৭০২ জন। অর্থাৎ দুই লাখ ৪০ হাজার ৯১৫ জন শিক্ষার্থী চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে আগের বছরের (২০১৪-১৫) তুলনায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ কমেছে ৩৪ হাজার ৯৪২ জন। এ ছাড়া দুই বছর আগে একাদশ শ্রেণীতে নিবন্ধন হয়েও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না দুই লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ জন শিক্ষার্থী।
২০১৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ২০১৬-২০১৭ সালে নিবন্ধন করেছিল ১৩ লাখ তিন হাজার ৭৮৬ জন ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ১০ লাখ ১৮ হাজার ৪১১ জন। এই হিসাবে এবার পরীক্ষার্থী কমেছে দুই লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৫ জন। এরা চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না।

গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার। গত বছরের তুলনায় এবার ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার।
শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়লেও প্রাথমিক-মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক কোনো স্তর থেকেই ঝরে পড়া রোধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৭ সালের জরিপ প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিকেও সরকারের উপবৃত্তি চালু রয়েছে মেয়েদের জন্য। ঝরে পড়া রোধে মেধাবৃত্তি দেয়া হায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে। উপবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে অতিদরিদ্র, নদীভাঙন, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য। এসব অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা আরো বেশি হারে উপবৃত্তি পায়।

এর পরও ঝরে পড়া বা শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি রোধ করা যাচ্ছে না।
শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাধ্যমিকে এসে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়াকে মেধার বড় ঘাটতি বলতে হবে। কারণ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের যেনতেনভাবে পাস করানো হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে এসে বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছে। এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী কেন উচ্চমাধ্যমিকে এসে ঝরে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুসন্ধান করা দরকার।
তারা আরো বলেন, এত বিপুল শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ না নেয়া উদ্বেগজনক। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো এ সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এ হার কমানো সম্ভব হলেও উচ্চমাধ্যমিকে এসে এটি বাড়ছে। এ স্তরে এসে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি হচ্ছে। এটিই উদ্বেগ ও আশঙ্কার কথা।
নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে এ কথাগুলো বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের অধ্যাপক রাশিদুল হাসান এবং শিক্ষা নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলোর মোর্চা গণস্বাক্ষরতার নির্বাহী পরিচালক ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।

উচ্চমাধ্যমিকে এসে প্রতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমাদের দেশের বাস্তবতার দিকে তাকালে ঝরে পড়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কেন বেড়েছে তা বোঝা যাবে। দারিদ্র্য তো আছেই, এ ছাড়া পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে মেয়েদের তড়িঘড়ি বিয়ে দেয়া হয়। তবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফলে ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও আগামীতে কমে আসবে। তিনি (ব্যানবেইস)’র ২০১৭ জরিপের কথা জানিয়ে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার বিগত বছরের চেয়ে কমেছে।
্আজ ২ এপ্রিল থেকে সারা দেশে একসাথে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি, মাদরাসা বোর্ডের আলীম ও কারিগরি বোর্ডের এইচএসসি (বিএম/ ভোকেশনাল) পরীক্ষা ২০১৮ শুরু হবে। পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণা বা প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে গত দু’দিন থেকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুক-হোয়াটআপসহ একাধিক সামাজিকমাধ্যমে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে অভিভাবকদের যোগাযোগের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ রূপ একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘চলে এলো ফোরজি এবারে প্রশ্নপত্র ফাঁসে হবে আরো দ্রুতগতি’।
এ রূপ প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কার মধ্যেই শুরু হচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো এবার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে প্রশ্নের। শিক্ষাবোর্ডগুলো এরই মধ্যে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করেছে। ৩০ মিটির পরে যারা ঢুকতে চাইবে তাদের নাম রোল ও রেজিস্ট্র্রেশন নাম্বার তালিকাভুক্ত করে রাখা হবে। এ রূপ ঘটনা কোনো শিক্ষার্থীর বারবার ঘটলে তাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। এমনকি তাকে গ্রেফতারও করা হতে পারে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ গজের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি থাকবে এবং তা কার্যকর করা হবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটি সূত্রে উপরোক্ত তথ্য ও ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে আরো বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন কেন্দ্রে পরিবহনে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ট্রেজারি বা থানা থেকে কেন্দ্রে দূরত্ব বিবেচনা করে প্রশ্ন সরবরাহ করা হবে। সূত্রগুলো বলছেন, প্রত্যেক কেন্দ্রের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট/ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। ট্রেজারি বা থানা থেকে কেন্দ্রসচিবসহ পুলিশ পাহারায় কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানো হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, কেন্দ্রসচিব ও পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বিশেষ নির্দেশনা মেনে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলতে হবে।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষার দিন সকালে লটারি করে প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করা হবে। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে জেলা প্রশাসকে জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি সে অনুসারে প্রশ্ন সেট কেন্দ্র সচিবদের জানিয়ে দেবেন।

বোর্ড চেয়ারম্যান আরো জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে প্রত্যেক কেন্দ্রের জন্য পৃথক খাম ও পৃথক সেটে সিকিউরিটি টেপ দিয়ে আটকানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা ট্র্রেজারিতে এ কাজ সম্পন্ন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার/ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সিকিউরিটি টেপ লাগানো হয়েছে। তাদের উপস্থিতিতেই কেন্দ্র সচিব তা খুলবেন এতে তাদের যৌথ স্বাক্ষর থাকতে হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/306846