২৭ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৫৭

অবকাঠামো নাজুক বিমানবন্দরগুলোর

যাত্রীর অভাবে একসময় সৈয়দপুর থেকে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল কয়েকটি এয়ারলাইনস। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যস্ততম বিমানবন্দরে পরিণত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের এই বিমানবন্দরটি। বর্তমানে ঢাকা থেকে এই গন্তব্যে বিমানসহ তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইনস দৈনিক ৯টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ছোট পরিসরের এই বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ বাড়লেও অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়েনি। বিমানবন্দরটির রানওয়ের অ্যাপ্রোচ লাইটিংয়ের স্বল্পতায় সন্ধ্যাকালীন একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের যাত্রীবাহী ফ্লাইট অল্পের জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
আকাশপথে অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহনে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও বিমানবন্দর অবকাঠামো সেভাবে বাড়েনি। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বিমান সংস্থাগুলোকে। এ অবস্থায় যাত্রীদের নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বিমান পরিষেবায় সবারই দৃষ্টি থাকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যের দিকে। অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ে বিমান কম্পানিগুলো আগে কম আগ্রহ দেখালেও বর্তমানে এ খাতই তাদের আশা জাগাচ্ছে। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট ও যশোরে বিমানের ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়েছিল। তার পর বিভিন্ন সময় কক্সবাজার, বরিশাল, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদীতে ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। তবে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কক্সবাজার ছাড়া বাকিগুলোতে ফ্লাইট নিয়মিত থাকেনি। ১৯৯৬ সালে অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট চালুর মধ্য দিয়ে দেশের বিমান ব্যবসায় বেসরকারি খাতের প্রবেশ ঘটে।

অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের উপস্থিতি পরবর্তী সময়ে কমলেও ক্রমবর্ধমান যাত্রী চাহিদার কারণে সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ফ্লাইট বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থা। কক্সবাজারে সপ্তাহে সাতটির পরিবর্তে ১০টি ফ্লাইট, ঢাকা-যশোর রুটে সপ্তাহে সাতটির পরিবর্তে আটটি এবং ঢাকা-বরিশাল রুটে সপ্তাহে দুটির পরিবর্তে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান বাংলাদেশ। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সপ্তাহে ৩০টি ফ্লাইট থেকে বৃদ্ধি করে ৩২টিতে উন্নীত করা হয়েছে এবং সিলেট রুটে ৩১টির জায়গায় ৩৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে বলে জানান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ।
এদিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ১৫ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে। এক বছরে যাত্রী বেড়েছে আড়াই লাখ; শতাংশের হিসাবে যাত্রী পরিবহন বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এর আগে এত যাত্রী পরিবহনে রেকর্ড নেই বিমানবন্দরটির।
চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সারোয়ার ই জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক রুটে বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থা কার্যক্রম বন্ধ করার পরও এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। বিদ্যমান সক্ষমতা ও লোকবল দিয়েই আমরা ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি সামাল দিচ্ছি। ভবিষ্যৎ চাহিদা মোকাবেলায় সরকার রানওয়ে সম্প্রসারণ, ট্যাক্সিওয়ে বাড়ানো, নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণসহ বেশ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।’

জানা গেছে, বছরে আড়াই লাখ যাত্রী বাড়লেও বিমানবন্দরে সুযোগ-সুবিধা ধারাবাহিকভাবে বাড়েনি। রাত ১১টার পর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামার সুযোগ নেই, বোর্ডিং ব্রিজ বা বিমানে ওঠার সেতু রয়েছে শুধু দুটি; ট্রানজিট যাত্রীর জন্য পৃথক লাউঞ্জ নেই, বিমান দাঁড়ানোর প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে নেই, ব্যাগেজের জন্য বেল্টের সংখ্যা মাত্র দুটি। ফলে যাত্রীদের লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়।
গত পাঁচ বছরে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী চলাচল বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু জনবল এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন সে অনুপাতে বাড়েনি। দিন দিন যাত্রী বাড়লেও বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, লোকবল এবং কারিগরি ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা সে হারে বাড়েনি। বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে শক্তিশালী করার জন্য গত বছর ৪৫২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও এখনো এর কাজ শুরু হয়নি।

ওসমানী বিমানবন্দরে প্রতিদিন আট থেকে ৯টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এর মধ্যে লন্ডন, আবুধাবি, দুবাই, জেদ্দা থেকে সরাসরি ফ্লাইট নামছে এ বিমানবন্দরে। তবে এখান থেকে সরাসরি বাংলাদেশ বিমানের কোনো ফ্লাইট দেশের বাইরে যাচ্ছে না। লন্ডন থেকে সরাসরি সিলেটে ফ্লাইট অবতরণ করলেও সিলেট থেকে ঢাকা হয়ে লন্ডন যেতে হয় যাত্রীদের।
ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমেদ জানান, ২০১৬ সালে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে চার লাখ তিন হাজার ৩০১ জন এবং ২০১৭ সালে তা বেড়ে পাঁচ লাখ ৯ হাজার ৪৬২ জনে দাঁড়ায়।
এদিকে রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দরে বেড়েছে যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি সেবার মান। বরং বেড়েছে নানা হয়রানি। বিমানে টিকিটের চাহিদা বাড়ায় হয়রানির মাত্রাও বেড়েছে। আবার বিমানবন্দরে যাত্রীদের অপেক্ষার কক্ষে বসে থাকতে গিয়েও বেড়েছে হয়রানি।
গত রবিবার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাজশাহী বিমানবন্দরের যাত্রীদের অপেক্ষমাণ কক্ষে তিলধারণের ঠাঁই নেই। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ইউএস-বাংলার যাত্রীদের স্বজনদের ভিড়, পাশাপাশি ঢাকায় যাওয়ার জন্য যাত্রী এবং তাদের স্বজনদের ভিড়। দ্বিমুখী এই ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বিমানবন্দরটি। এমনকি ভিআইপিদের বসার কক্ষটিও লোকে লোকারণ্য ছিল।

রাজশাহী বিমানবন্দরের ইনচার্জ সেতাফুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, রাজশাহী থেকে এখন প্রতিদিন দুটি করে বিমান চলাচল করছে। এর মধ্যে একটি হলো ইউএস-বাংলা, অন্যটি বাংলাদেশ বিমান। বিমান চলাচলে ব্যবহৃত রানওয়েটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত রয়েছে। রাতের সিগন্যাল লাইটগুলো আধুনিক করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
বরিশাল বিমানবন্দরে যাত্রী বাড়ায় আজ মঙ্গলবার থেকে ছয়টি ফ্লাইট চালু হচ্ছে। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকে ২৬৬টি ফ্লাইটে করে ১৬ হাজার ৩৭৮ জন যাত্রী বরিশাল বিমানবন্দরে নেমেছে। একই সময়ে ১৭ হাজার ৫৩০ জন যাত্রী বরিশাল বিমানবন্দর ছেড়েছে।
বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. হানিফ গাজী কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পাশাপাশি রাত্রিকালীন ফ্লাইট ওঠানামার জন্য ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ফ্লাইট বিলম্ব হলে পাইলটরা ঝুঁকি নিয়ে বরিশালে আসতে চান না। রানওয়েতে আলোর ব্যবস্থা হলে যাত্রী পরিবহনে আরো গতি আসবে।

সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয় ১৯৭৭ সাল থেকে। বর্তমানে এই বিমানবন্দরের রানওয়ের অ্যাপ্রোচ লাইটিংয়ের কাজ চলছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ এই অ্যাপ্রোচ লাইটিংয়ের কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানান সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক মো. শাহীন আহমেদ। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন মোট ৯টি ফ্লাইট ঢাকা-সৈয়দপুর-ঢাকা পথে চলাচল করছে।
যশোর বিমানবন্দরে প্রতিদিন ১০টি ফ্লাইট যাতায়াত করে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি কার্গো বিমানও যাতায়াত করে। তবে এই বিমানবন্দরে একসঙ্গে চারটি বিমান দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়ানোর জায়গা, বড় রানওয়ে নেই। কনকর্স হলে যাত্রীদের বসার জায়গাও সীমিত। একসঙ্গে দুই-তিনটি বিমান নামলে যাত্রীদের বসার স্থানের সংকট দেখা দেয়। রানওয়ের দৈর্ঘ্যও কম। ফলে বড় আকারের বিমান অবতরণের ব্যবস্থা নেই। এই বিমানবন্দরের রানওয়ের বেইসের শক্তি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন পাইলটরা।

একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশ এত ছোট যে ডমেস্টিক ফ্লাইট চালিয়ে লাভ করা কঠিন। রাস্তাঘাট খারাপ থাকায় মানুষ বিমানে যেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর চাপ বাড়ায় তা সামাল দিতে এয়ারক্রাফট শিডিউল ঠিক রাখা কঠিন হচ্ছে। কারণ এক বা একাধিক এয়ারক্রাফট দিয়েই বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হচ্ছে।’ এয়ারপোর্ট অবকাঠামোর ঘাটতি ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কথাও স্বীকার করে তিনি বলেন, ইচ্ছা করলেই ব্যবস্থাপনায় রাতারাতি পরিবর্তন আসবে না।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে যাত্রী পরিবহন দ্রুত বাড়ছে, সে জন্য এখনই আমাদের অবকাঠামো বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা সংসদীয় কমিটি থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছি। যদিও সিভিল এভিয়েশন এ ব্যাপারে কাজ করছে, কিন্তু এই সুবিধা আমাদের প্রতিনিয়তই বাড়াতে হবে।’

সাবেক এই বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো বেশি মুনাফা করতে গিয়ে মানুষকে বিপদে ফেলছে। আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম তখন জিএমজি এয়ারলাইনস বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিরাপত্তার ব্যাপারে এয়ারক্রাফটের যন্ত্রপাতি যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে তাদের গাফিলতি ছিল। আমি তাদের সতর্ক করে দিয়ে পরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সে সময় আমার ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনকি দুই-তিনবার আমি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। বিমান চালাতে হলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মিথ্যা অজুহাত দিয়ে টাকা কামাই করা প্রাইভেট এয়ারলাইনসকে বন্ধ করতে হবে।’
বিশ্বে অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্রাজিলের পরই ভারতের অবস্থান। ২০২০ সাল নাগাদ ৪৫ কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণ পথে উড়োজাহাজে চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে ভারত কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইটে যাতায়াত করে এমন যাত্রীর সংখ্যা বছরে প্রায় ১১ লাখ।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/03/27/618065