২৭ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪৯

বাঁধ নির্মাণে শত কোটি টাকা লোপাটের ফাঁদ

প্রি-ওয়ার্কে প্রকৃত চিত্র গোপন করে লুটপাটের সংস্থান রাখা হয়েছে * ঘাস লাগানো ও মাটি বসাতে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন ছিল না * চূড়ান্ত বিল পরিশোধে পাউবোর টাস্কফোর্সের সমন্বয় চান জেলা আওয়ামী সভাপতি


সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে রীতিমতো হরিলুট শুরু হয়েছে। প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ, কম দরে মাটি কেটে বেশি দরে বিল উপস্থাপনসহ ধাপে ধাপে চুরি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কাজের সিডিউলে ঘাস লাগানো ও মাটির স্থায়িত্ব (কম্পেকশন) মজবুত করার জন্য আলাদা টাকা দেয়া হলেও সেটি করা হয়নি। ১৭৭ কোটি টাকার কাজে ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে ৬৬টি কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতেই বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন বাকি ১১১ কোটি টাকার বিল তুলে নিয়ে পকেটস্থ করার তোড়জোড় চলছে। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এসব চিত্রই বেরিয়ে এসেছে। হাওর এলাকার বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এলাকার বিশিষ্টজনরা ধারণা করছেন এই বাঁধ নির্মাণে প্রস্তাবিত (১৭৭ কোটি টাকা) চারভাগের তিনভাগ টাকা আত্মসাতের ফাঁদ পাতা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) জেলা কমিটির সভাপতি ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘হাওর রক্ষা বাঁধের সার্ভে রিপোর্ট করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যেভাবে সার্ভে করা হয়েছে হাওর রক্ষার স্বার্থে সেভাবেই বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। তবে বৃহস্পতিবার (২২ মার্চ) পর্যন্ত ৬৬ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তবে কাজের বাইরে অতিরিক্ত এক টাকাও পরিশোধ করা হবে না।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, হাওর রক্ষা প্রকল্প করার আগে নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে। প্রকল্প প্রাক্কলন, অ্যাসেসমেন্ট, নকশা সবই করে পাউবো। অথচ কাজ বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এটা হতে পারে না। তারপরও জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এবার হাওর রক্ষায় চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সিন্ডিকেটভুক্ত পিআইসি কমিটির কারণে তা ম্লান হতে পারে না। দুর্নীতি না হলে কীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা যায় তার প্রমাণ ডিসি দিয়েছেন। তাই বড় বড় বরাদ্দে যে টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে তা যেন পাউবোর টাস্কফোর্স দ্বারা যাচাই-বাছাই করা হয়। না হলে সরকারের শত কোটি টাকা বর্গমিটার, লেবার আর এসকেভেটর যন্ত্রের আড়ালে লোপাট করা হবে। তাই সরকারি টাকার অপচয় ঠেকাতে মন্ত্রণালয়কে কঠোর হতে হবে।
যেভাবে বাড়ানো হয় প্রকল্প ব্যয় : মাঠ পর্যায়ে বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়নে গঠিত প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট কমিটির (পিআইসি) সদস্যরা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন বা তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেজন্য বাঁধ নির্মাণের সিডিউলে ধাপে ধাপে টাকা ভাগ করে দেয়া হয়। কাজের স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সবক’টি বাঁধে প্রতি বর্গমিটারে (১০ দশমিক ৭৮ বর্গফুট) ঘাস লাগানোর জন্য ২৫ টাকা ৬৭ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এ ছাড়া বাঁধের স্থায়িত্ব মজবুত (কম্পেকশন) করতে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৩৭ টাকা ধরা হয়। এই দুটি প্রক্রিয়া ৯৮ পার্সেন্ট পিআইসিই অনুসরণ করেনি। অন্যদিকে শ্রমিকরা ৯৮ ফিট দূরত্বের মধ্য থেকে বাঁধে মাটি ভরাট করলে এক ঘনমিটার মাটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৬ টাকা ৬০ পয়সা। আর এসকেভেটর দিয়ে মাটি কাটা হলে প্রতিবর্গ মিটারের জন্য ১১৩ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়। প্রস্তাবিত ১৭৭ কোটি টাকার মধ্যে ঘাস আর কম্পেকশনের জন্য দেয়া ৪৩ কোটি টাকা আলাদা করে অবশিষ্ট ১৩৪ কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, ঘাস ও কম্পেকশনের জন্য এত টাকা বরাদ্দের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ কোনো বাঁধেই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কয়েকটি বাঁধে কিছু কিছু ঘাস লাগানো হলেও তা একান্তই আইওয়াশ। এ কারণে এই ৪৩ কোটি টাকা পরিশোধে পাউবো আপত্তি জানাবে। এদিকে ব্যয় বাড়ানোর প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে পাউবোর একজন শাখা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে। চূড়ান্ত বিল কীভাবে করা হচ্ছে তা জানতে যোগাযোগ করা হয় শাল্লা উপজেলা পিআইসি কমিটির সদস্য সচিব ও পাউবোর শাখা কর্মকর্তা শমশের আলীর সঙ্গে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁধের সার্ভে করেছে একটি প্রাইভেট কোম্পানী। টেন্ডারের মাধ্যমে এই সার্ভে টিম নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের সার্ভে যদি ভুলও হয়ে থাকে তাহলে পোস্ট ওয়ার্কে (কাজ শেষ হওয়ার পর চূড়ান্ত মাপ) তা ধরা পড়বে। গত বছরের চেয়ে এবার ৩০ পার্সেন্ট খরচ বেড়েছে। যদি লেবার দিয়ে মাটি কাটা হয় তাহলে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই লাগবে। তিনি বলেন, শ্রমিকরা প্রতি হাজার মাটির জন্য নেয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। সবাই তো আর এসকেভেটর সংগ্রহ করতে পারে না। তাহলে আপনারা গড়ে শ্রমিকের হিসাবে বিল করছেন কিনা জানতে চাইলে এই এসও বলেন, ‘এখন সবই লেবার রেটে (শ্রমিকের দর) চলে আসছে। ৪শ’ মিটার বাঁধে ৮ ফুট উচ্চতায় বাঁধ দেয়া হলে সাড়ে ৩ লাখ সিএফটি মাটিতে চারশ’ মিটারের একটি বাঁধ শেষ করতে ২৪ লাখ টাকা তো লাগবেই।’ এই দর কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিউবিক মিটার প্রতি ২৩৮ টাকা দরে ২৪ লাখ টাকাই আসে। শমশের আলীর সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা হচ্ছে তারা মাটির উচ্চ মূল্য দরেই বিল পরিশোধ করতে চাইছেন। এ হিসেবে পিআইসিদের টাকা পরিশোধ করা হলে সরকারের গচ্চা যাবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে সিডিউল অনুযায়ী যে দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা না মেনে সব ক’টি উপজেলা কমিটির হর্তাকর্তারা গোপনে ইঞ্জিনিয়ারিং কারচুপির আশ্রয় নিয়েছেন। তারা শেষ দুটি বিলের বড় একটি অংশের ভাগ পেতে পিআইসি সদস্যদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ৯০ ভাগ বাঁধেই মাটি ভরাট হয়েছে এসকেভেটর দিয়ে। পাউবোর সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম এবং সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন। অথচ উপজেলা পিআইসির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা গড়ে শ্রমিকের উচ্চ মূল্য হিসাবে বিল করে অন্তত ৫০ কোটি টাকা ভাগাভাগির পাঁয়তারা করছেন বলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে এবার সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষায় ৯৬৪টি পিআইসির অনুকূলে এ পর্যন্ত ১২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চাহিদা নির্ধারণ করা হয় ১৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে নিযুক্ত পিআইসি কমিটিকে ছাড় দেয়া হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা। এখন বাকি দুটি বিলের অপেক্ষা করছে পিআইসি সদস্যরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘১২ মার্চ এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকসহ পিআইসি কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের দাফতরিক পত্র দেয়া হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে নীতিমালা অনুসরণ না করার বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কাজ না হলে বিল দেয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কাজ না করে টাকা তুলে নেয়ার দিন শেষ।’

অসামঞ্জস্য বরাদ্দ : শাল্লা উপজেলার বিভিন্ন হাওর রক্ষা বাঁধের বাস্তব চিত্র দেখতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে কুশিয়ারা নদীর ডান তীর নিয়ে ৭টি পিআইসির দিকে। এই ৭টি পিআইসিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর তীর ভরাটের কাজ পাওয়া ৭ জনই এই উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল আমিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ৭টি পিআইসিরই নদী তীর একই রকম হলেও বর্গমিটারের আড়ালে প্রত্যেকটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা বেশি। শাল্লার পিযুশ কান্তি দাস ৪শ’ মিটার বাঁধে মাটি ভরাটের কাজে বরাদ্দ পেয়েছেন ২৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা, মো. রমজান মিয়া ৪০৫ মিটার এলাকার জন্য ২০ লাখ সাড়ে ৫২ হাজার টাকা, ৩৪৬ মিটারের জন্য ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, সাদ্দাম হোসেন ২৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, ১২শ’ ৫০ বর্গমিটারের জন্য ২৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, নিতাই চাঁদ দাস ২০ লাখ সাড়ে ১৬ হাজার টাকা এবং রান্টুলাল দাস ২৮৫ মিটারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন ১২ লাখ সাড়ে ৫ হাজার টাকা। এভাবে সব বাঁধের প্রকৃত চিত্র গোপন করে প্রিওয়ার্কের সময়ই বরাদ্দ বেশি দিয়ে লুটপাটের আগাম সংস্থান রাখা হয়। এখানে উল্লেখ্য, শাল্লা উপজেলাই হচ্ছে জেলার একমাত্র অবহেলিত এলাকা। এ কারণে তথ্যানুসন্ধানের মাপকাঠি হিসেবে এ এলাকাটিকে বেছে নেয়া হয়।
বাঁধের প্রিওয়ার্কের সময়ই যে গোপন বরাদ্দের সংস্থান রাখা হয়েছে তার বাস্তব চিত্র পোস্ট ওয়ার্কেই ধরা পড়বে উল্লেখ করে শাল্লার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট অবনি মোহন দাস বলেন, শুধু কুশিয়ারা তীর নয়। জেলার বিভিন্ন হাওর রক্ষার নামে কোটি কোটি টাকার উপ-প্রকল্প করে লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে শাল্লা উপজেলা সফর করে প্রধানমন্ত্রী জনগণকে আগামী ফসল রক্ষায় সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন সেই উপজেলায় এবার বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে ২৫ দিন পর। পিআইসি সদস্যদের নির্দিষ্ট এলাকায় সাইনবোর্ডে কাজ শুরুর তারিখে ২৫ দিন গোপন রাখার শর্ত দেয়া হয়েছে কী কারণে তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

মাটি কাটায় পুকুর চুরি : যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে মাঠ পর্যায়ে এসকেভেটর ও শ্রমিকের মাধ্যমে মাটি ভরাটের খরচের বিষয়টিও যাচাই করা হয়। সরেজমিন শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের কাশিপুর এলাকায় কালিকোটা হাওরে ২২টি পিআইসি গঠন করার তথ্য পাওয়া যায়। এতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সেখানে একটি বাঁধে মাটি ভরাটের কাজে নিয়োজিত এসকেভেটর পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এখানে টাকা বরাদ্দে ভয়াবহ দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। একেকটি বাঁধে এসকেভেটর দিয়ে সর্বোচ্চ খরচ হবে ৬ থেকে ৭ লাখ। সেখানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২২ থেকে ২৪ লাখ টাকা। তিনি বলেন, একজন শ্রমিক হিসেবে আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। তিনি বলেন, প্রতি ঘণ্টার জন্য একটি এসকেভেটর সর্বোচ্চ তিন হাজার ৬শ’ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। আর একটি এসকেভেটর প্রতি ঘণ্টায় ২ হাজার সিএফটি মাটি কাটতে সক্ষম। এ হিসেবে কালিকোটা হাওর রক্ষায় নেয়া ২২টি প্রকল্পে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই কোটি টাকা খরচ হবে। সেখানে সাড়ে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া মানেই সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের ফাঁদ পাতা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সৎ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সবকটি বাঁধ সঠিকভাবে মাপ দিলেই লুটপাটের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।’

দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, তারাপাশা গ্রামের সৈয়দ ইয়াউর রহমান, সৈয়দ তহুর আলী ও সৈয়দ রাসেল আহমেদ তিন ভাইকে তিনটি পিআইসির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৭ নং পিআইসির সভাপতি সৈয়দ রাসেল আলী ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকার মাটি ভরাটের কাজটি মাটি শ্রমিক সর্দার জারলিয়া গ্রামের লেবু মিয়ার কাছে ১ লাখ টাকায় চুক্তি করেন। লেবু মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘১ লাখ টাকায় কাজটা নিয়ে লোকসানে পড়েছি। কী করব, এলাকায় কাজ নেই। কথা বলে আটকে গেছি।’ এই রাসেল মিয়ার মতো অনেক প্রকল্প চেয়ারম্যান শ্রমিক সর্দারদের কাছে কম দামে মাটি কাটার কাজ বিক্রি করে লাভের খাতা খুলেছেন। পাশেই ৭৪ নং পিআইসি সভাপতি জাকারিয়া হোসেনের প্রকল্পে ৩৮শ’ টাকা দরে প্রতি হাজার সিএফটি মাটি কাটছিলেন শ্রমিক সর্দার আবাব মিয়া। অথচ শাল্লার শাখা কর্মকর্তা শমশের আলী গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা প্রতি হাজার সিএফটি দরে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগির সংস্থান করে দিচ্ছেন। এই চিত্র জেলার সব পিআইসিতে।
দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলতাব উদ্দিন বলেন, ‘পিআইসিদের তালিকায় সভাপতি/সম্পাদক পদে বিভিন্ন নাম থাকলেও এর পেছনে আছে শক্তিশালী গডফাদার। নামে পিআইসি চেয়ারম্যান করা হলেও টাকা উত্তোলনের ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর করেন আড়ালে থাকা সেই গডফাদাররা। এরা এবারও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। বিষয়টি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন চূড়ান্ত বিল পরিশোধ না করা হয়।’ প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘এটা হাওরবাসীর দাবি।’
আওয়ামী লীগের এই নেতার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, কালিয়াকোটা হাওর রক্ষায় ২২টি প্রকল্পে স্থানীয় আটগাঁও ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম ব্যাপক প্রভাবশালী হিসেবে নিজেকে জাহির করেন। তিনি নিজে ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নং পিআইসির চেক পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ৫টি পিআইসিতে যাদের সভাপতি করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই আবদুস সালামের ঘনিষ্ঠ। তিনিও আল আমিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। যোগাযোগ করার চেষ্টা হয় শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে বর্ধিত সময় শেষ হয়েছে গত ১৫ মার্চ। তবে একমাত্র ধর্মপাশা উপজেলা ছাড়া অন্য ১০ উপজেলা থেকে একটিও প্রগ্রেস রিপোর্ট পাঠানো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রগ্রেস রিপোর্ট না পাঠানোর একমাত্র কারণ তৃতীয় ও চতুর্থ বিলে আটকে থাকা বরাদ্দের আরও অর্ধেক টাকা ভাগিয়ে নেয়া। এ কারণে কয়েকজন ইউএনও পাউবোর শাখা কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে সিন্ডিকেট করেছেন। একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও বাঁধে অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রতিবাদ করেননি। অথচ সাধারণ মানুষের মধ্যে জেলার সর্বত্র এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/31827