২৬ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৯:০০

ভৈরব নদের আর্তনাদ

বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখছে। যেন কারো কিছুই করার নেই। মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে কেউ এগিয়ে আসছে না। কারো কানে পৌছাচ্ছে না বেদনাঘন আর্তি। এটি যশোর-খুলনার ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদের। নদটির বুক জুড়ে হাহাকার বহুদিনের। ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার ভৈরব নদ কাঁদতে কাঁদতে একেবারে কাতর হয়ে পড়ছে। নদে পানি নেই। পানি আছে নদপাড়ের লোকজনের চোখে। নদের করুণদশা দেখে ভৈরবের মতো কাঁদছে নদপাড়ের লক্ষ লক্ষ মানুষও। অথচ ঐতিহ্যবাহী নদটির যৌবনে বিশাল দাপট ছিল। ছিল ভৈরবী গর্জন। কলকল ছলছল নদী করে টলমল-অবস্থা যখন ছিল তখন নদপাড়ের বাসিন্দারা শিশু সন্তানদের সাবধানবাণী উচ্চারণ করতেন ‘তোরা যাসনে নদের ধারে, ভৈরবের উত্তাল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, খালি হবে বুক’। আসলেই নদে তুফান এলে মানুষের বুক কাঁপতো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে চমকে উঠতেন অনেকে। নদের হিংস্রতার কাছে হার মানতো সবাই। সেই ভৈরব নদের বিশাল দেহটা শুকিয়ে গেছে। ভারতের হিং¯্রতায় একেবারে নিথর হয়ে পড়েছে। নদের অধিকাংশ এলাকা খাঁ খাঁ করছে। নদ পানিশূন্য হয়ে পড়ায় কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি, বনজ, মৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ভৈরব নদের ভৈরবী গর্জনের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে এখন কল্পকাহিনী। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর মধ্যে ভৈরব নদ ছিল সবচেযে গভীর। সেই ভৈরব নদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। মানচিত্র থেকে মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে নদটি। নদ বাাঁচানোর আন্দোলন হয়েছে বহুবার। কিন্তু বাস্তবে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে নদের যশোরের অংশবিশেষ খননের প্রকল্প পাস হলেও আটকে আছে নানা জটিলতায়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঐহিত্যবাহী ভৈরব নদটি গঙ্গা থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে সীমান্ত জেলা মেহেরপুরে ঢুকেছে। মেহেরপুরের সুবলপুর পয়েন্টে মিশেছে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে। ভৈরব আর মাথাভাঙ্গা অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। ওই পয়েন্ট থেকে দর্শনা ও জীবননগর হয়ে ভৈরব নদ এসে মিশেছে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের সাথে। সেখান থেকে ভৈরব নদ যশোর ও শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে শিল্পনগরী খুলনা ছুঁয়ে সুন্দরবনের পশুরনদীতে গিয়ে মিশেছে। ভৈরব নদকে ঘিরেই মূলত যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনায় নগর, শহর ও শিল্প গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যও স¤প্রসারিত হয়। ভৈরব নদে একসময় বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। এখন ভৈরবে নদীপথ নেই বললেই চলে।

নদটির গুরুত্ব¡ রয়েছে অনেক। কিন্তু গুরুত্বটা অনুধান করছে না সংশ্লিষ্টরা। যার জন্য নদ বাঁচানো কিংবা দখলমুক্ত করার উলে-খযোগ্য উদ্যোগ নেই। শুধু যশোর এলাকা নয়, বলা যায় পুরো ভৈরব নদটি দখল করে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট ও বড় অর্ধশতাধিক নদ-নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী শুকিয়ে গেছে ভৈরব নদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশ্লি¬ষ্ট সুত্রে জানা গেছে, ৪ শতাধিক কিলোমিটার নদপথের প্রায় আড়াইশো’ কিলোমিটার শুকিয়ে গেছে। যার কোন কোন অংশে নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ায় ভৈরব নদের প্রায় পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। কোথাও নদের পাড় পাওয়া যাবে না যেখানে দখল হয়নি। অনেকে কাগজপত্র তৈরী করে ব্যক্তি সম্পত্তি করে নিয়েছে নদের জমি। নদের প্রশস্ততা কমে গিয়ে নদ কেন খাল হলো কিংবা ব্যক্তি সম্পত্তি হলো কিভাবে-এসবের কোন তদন্ত হয়নি কখনো।

চৌগাছার তাহেরপুর পয়েন্ট থেকে খুলনা পর্যন্ত যশোর, নওয়াপাড়া, বসুন্দিয়া, বারীনগর, ডাকাতিয়া, নওদাগা’, বিরামপুর, ঘোপ, পুরাতন কসবা, নীলগঞ্জ ও বারান্দীপাড়াসহ বিভিন্নস্থানে সরেজমিনে ঘুরে ভৈরব নদ দেখা গেছে সিংহভাগ এলাকা শুকিয়ে গেছে। শুকিয়ে যাওয়া নদপাড় ও অনেকস্থানে নদের বুকে দখল করেছে যে যার মতো। আবার অনেকস্থানে মরা নদের প্রায় বুক পর্যন্ত দখল করে পাকা বাড়ী হচ্ছে। নদের সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগও কখনো নেয়া হয়নি। শিল্পশহর নওয়াপাড়া ও মহানগর খুলনার ভৈরব নদপাড়ও দখল হয়েছে। দখলদারদের দাপটের কারনে নওয়াপড়ার নদীবন্দরের কাজকর্মে গতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রবীনদের কথা, ভৈরব নদ ছিল বিশাল চওড়া। এমনভাবে দখল হয়েছে যে নদ ছোট খালে পরিণত হয়েছে। ভৈরব নদ দখলমুক্ত করে যশোর শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় ‘রিভার ভিউ’ গড়ে তোলার দাবী করা হয়েছে বহুবার। যা জনদাবীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দাবী পুরণ হচ্ছে না। নদও হচ্ছে না দখলমুক্ত।
নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন ও পর্যবেক্ষক মহল অভিমত ভৈরব নদ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় যশোর ও খুনার বিরাট এলাকার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে গেছে শিল্প কলকারখানার গতি। কৃষিও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। ভৈরব নদের ২লাখ জেলে পরিবার হয়ে পড়েছে বেকার। জীবন ও জীবিকার সংকট ক্রমেই মারাত্মক হচ্ছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/123284