২৬ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৮:৫৫

খেলাপি ৭২৩ কোটি টাকা

জড়িতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাসহ জেলে পাঠানো নিশ্চিত করতে না পারলে এ লুটপাট কোনো দিন বন্ধ হবে না -মন্তব্য বিশ্লেষকদের * এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩২২ শতাংশ * ফেরত দিতে পারছে না আমানত

হু-হু করে বাড়ছে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। পাশাপাশি বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক এবং আইসিবির (ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) কাছে ১১০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এ টাকা দেয়ার ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘সবুজ সংকেত’ মিলেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭২৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ছিল ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা বা ৩২২ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংক বিশ্লেষকদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি আদায়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। তাদের অভিমত- ব্যাংকের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জেলে পাঠাতে হবে। জড়িতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাসহ জেলে পাঠানো নিশ্চিত করতে না পারলে এ লুটপাট কোনো দিন বন্ধ হবে না। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন তো এমন পারসেপশন হয়ে গেছে যে, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করলে কিছু হয় না। এ রকম বহুলোক দিব্বি বহালতবিয়তে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্ষমতাবানরা ঋণ পুনর্গঠন করে আরও ঋণ নিচ্ছেন। তাই এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করলেও কোনো বিচার হয় না, উল্টো ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয় সরকার; এটি দুর্নীতিবাজদের আরও বড় ধরনের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করবে বলেও মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই অথবা নিয়মনীতি অনুসরণ না করে ঋণ বিতরণ, উদ্যোক্তাদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ, অস্তিত্বহীন বা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া এবং ঋণের বিপরীতে ভুয়া জামানত দেখানো অথবা জামানতকে অতি মূল্যায়িত করার কারণেই মূলত দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ ছাড়া এডিআর (অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও বা আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ সীমা) অতিক্রম করে ঋণ প্রদান করায় এ মুহূর্তে তীব্র তারল্য সংকট অথবা একরকম অর্থশূন্যতায় ভুগছে ব্যাংকটি। যার কারণে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে গড়িমসি করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের আমানত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অঙ্কের আমানতকারী রয়েছেন ১ হাজার ২১৬ জন। এদের কাছ থেকে ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করেছে প্রায় ২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া শীর্ষ ১০ আমানতকারীর কাছ থেকে নিয়েছে ৬৮৭ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, ২৫ লাখ টাকা বা তার উপরের অঙ্ককে বড় আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি যারা খারাপ করেছে, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে কিছু টাকা আদায় করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদালতের সহযোগিতা নিতে পারে। তবে এটি করতে অনেক সময় লাগবে। এতকিছুর পরও সরকার কেন এ ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখতে চায়- জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, মূলত বেসরকারি ব্যাংকের পতন হলে মানুষের আস্থা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সে বিবেচনায় হয়তো ব্যাংকটিকে বাঁচানোর চেষ্টা। তবে বেশি অর্থ নয়, সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে ব্যাংকটিকে টেনে তোলা যায় কিনা, সেটি ভেবে দেখা উচিত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ যারা ব্যাংকটি লুটপাটে জড়িত, তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে অর্থ আদায় করে নিতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেবে। সে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে তাদের আছে।
এ বিষয়ে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত যুগান্তরকে বলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭২৩ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাপারে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা বা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি- না জানতে চাইলে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু যুগান্তরকে বলেন, বেশকিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে ঠিক কতজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্ত্তী যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে যা ঘটেছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য সবকিছু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হয়েছে। তবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকটির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, ‘স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি আমাদের প্রতিশ্র“তি’- এমন স্লোগান নিয়েই যাত্রা শুরু করে ফারমার্স ব্যাংক। কিন্তু উদ্যোক্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটে সব স্বপ্ন লুটিয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায়ই পতনের মুখে পড়েছে ব্যাংকটি।
সূত্র জানায়, কার্যক্রম শুরুর পরপরই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর বেরিয়ে আসে। কিন্তু এসব বিষয় আমলে না নিয়ে উল্টো সাধারণ মানুষকে আমানতে অধিক সুদ দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে পুরো ব্যাংকিং খাতে যখন আমানতের সুদ ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে যায়, তখনও ফারমার্স ব্যাংক আমানতে সর্বোচ্চ ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদ দিত। আর এভাবেই সাধারণ মানুষ ও সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ঋণ বিতরণের নামে এসব টাকার বেশিরভাগ চলে যায় উদ্যোক্তা, লুটপাটকারী ও সংশ্লিষ্টদের পকেটে। ফলে ফারমার্স ব্যাংক হয়ে পড়ে অর্থশূন্য। এখন লাভ তো দূরে থাক, গ্রাহকের মূল টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি।
এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী স্ব স্ব পদ এবং পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, তারল্য সংকটের কারণে ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। পরে ফেব্র“য়ারিতে তিনি বলেন, কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে রেগুলেটরি ও অত্যাবশ্যকীয় নিয়মকানুন মানতে অনীহা এবং পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে।

এরপরই ফারমার্স ব্যাংককে উদ্ধারে তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। সব পক্ষ থেকে ব্যাংকটিকে ‘বাঁচানো’র দরকার নেই বললেও সরকার বলছে, কোনো ব্যাংককে ধ্বংস হতে দেয়া হবে না। সে কারণে ফারমার্সকে কোন উপায়ে অর্থ দেয়া যায় সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটা নিয়ে দরকষাকষি চলছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ৬০ শতাংশ শেয়ার লিখে দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক টাকা দেবে ফারমার্স ব্যাংককে।
সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট আলোচনার পর সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী বলেন, আলোচনায় থিংকট্যাংকগুলোর কাছ থেকে পরামর্শ এসেছিল, ‘লেট দেম ডাই’। ফারমার্স ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংককে কলাপস হতে দেব না। যেভাবেই হোক একে রক্ষা করতে হবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনবে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এ বিষয়ে আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মজিব উদ্দিন আহামেদ যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংককে টাকা দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখনও আগের মতো আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে।



https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/31545