খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের অবকাঠামো, যন্ত্রাংশ, পরিবহন সবই এখন পরিত্যক্ত
২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ১২:৪৪

বন্ধ নিউজপ্রিন্ট মিল নিয়ে দেড় যুগ ধরে শুধুই পরিকল্পনা

রক্ষণাবেক্ষণে খরচ ৩৫ কোটি টাকা

ব্রিটিশরা কারখানা চালু করে দিয়ে চাবি নদীতে ফেলে গেছে। তাই মিল বন্ধ করা যায় না। চালু থাকার সময় কয়েকটি দিন ছাড়া সারা বছর দিন-রাত কারখানা চলত। আর সেই মিল এখন চালু নিয়ে সরকারগুলোর শুধুই পরিকল্পনা। আওয়ামী লীগ বলেন বিএনপি বলেন কেউ এই মিল চালু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। মজা করে হলেও কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন একসময়ের মিলশ্রমিক গোলাম মোস্তফা। মিলটিতে নিরাপত্তাকর্মী আসাদুজ্জামান বললেন, মিলটি যখন চালু ছিল, তখন দিন-রাত বোঝা যেত না। ২৪ ঘণ্টাই উৎপাদন হতো। আর এখন রাতে ভয় করে। সব জায়গায় জঙ্গল আর জঙ্গল।

সরেজমিন মিল ও কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঠ টানায় ব্যবহৃত দু’টি ক্রেন। পরিত্যক্ত অবস্থায় মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে মিলের পেছনে নদীর ঘাটে বাধা দু’টি কার্গো জাহাজ। দেড় দশক ধরে তালাবদ্ধ বয়লার। পাল্প তৈরির জন্য গাছ কেটে রাসায়নিক দিয়ে তা সেদ্ধ করার ১০টি বিশালাকৃতির যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। গাছ টানার জন্য ক্রেন লাগানো গাড়িগুলো হয়তো কখনোই চলবে না। কারখানার ছাদের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি। সব মিলিয়ে এর স্থাপনা, অবকাঠামো, পরিবহন সবই এখন জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত। কারখানা চত্বরের বাইরে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল ও কোয়ার্টার যা আছে তাও ব্যবহারের অনুপযোগী। শুধু প্রশাসনিক ভবনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। একমাত্র স্কুলটি এখন মিলের পরিবেশ বাঁচিয়ে রেখেছে। ১৬ বছর আগেও এই মিলে দিন-রাত কাজ করতেন আড়াই হাজার শ্রমিক। সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ দিয়ে বছরে উৎপাদন হতো ৪৮ হাজার মেট্রিক টন নিউজপ্রিন্ট কাগজ। প্রতিদিন ট্রাকে সেই নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ হতো সারা দেশে। তবে সেসব এখন ইতিহাস। প্রায় ৮৮ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মিলটি পাহারা দেয়ার জন্য বর্তমানে আছেন ৫৬ জন গার্ড ও আনসার। আর স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২২ জন। যাদের পেছনে প্রতি বছর বেতন বাবদ সরকারের প্রায় ১৬ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিল, অফিসরুম, গেস্ট হাউজ, পানির পাম্প রক্ষণাবেক্ষণে বছরে খরচ হয় আরো প্রায় এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। গত ১৮ বছরে বন্ধ এ মিলে খরচের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।

মিল সূত্রে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতাধীন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলটি বিরাষ্ট্রীয়করণের জন্য ২০০৫ সালে বিলুপ্ত প্রাইভেটাইজেশন কমিশনে তালিকাভুক্ত হয়। তিন বছর পর বিক্রির জন্য দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে বিক্রি না হওয়ায় ২০০৮ সালের আগস্টে মিলটি আবারো শিল্প মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসে। পরের বছর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিলটি আবার চালু করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি কারিগরি সমীক্ষা চালায়। তারা প্রস্তাব করে ৪২২ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলে তিনটি নতুন যন্ত্র দিয়ে উন্নত মানের সাদা কাগজ উৎপাদন করা যেতে পারে। অবশ্য সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০১৪ সালে বন্ধ শিল্পে প্রাণ ফেরাতে বিলুপ্ত প্রাইভেটাইজেশন কমিশন খুলনা হার্ডবোর্ড মিলসহ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রস্তাব পাঠায়। তবে সেই উদ্যোগও সফল হয়নি।

মিলটির হেড অব প্রজেক্ট নুরুল্লাহ বাহার বলেন, বন্ধ থাকা মিলের ৫০ একর জমি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পিডিবিকে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বাকি ৩৮ একর জমিতে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন কাগজকল স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেখানে ৩০ হাজার মেট্রিক টন সাদা প্রিন্টিং কাগজ এবং ১৫ হাজার মেট্রিক টন অফসেট, লেজার ও মেনিফোল্ড কাগজ তৈরি করা যাবে। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নতুন যন্ত্রপাতি দিয়ে মিলটি চালু করতে সময় লাগবে। মিলের ভেতরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন দিয়েই এটি চালানো হবে। তবে জানা গেছে, নতুন মিল স্থাপন প্রকল্পের ফাইল নড়ছে না।

খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ মোশারেফ হোসেন বলেন, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আধুনিক কাগজ মিল করার উদ্যোগটি সরকারের দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। তাতে স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ সমস্যারও সমাধান হবে। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ আসবে।
খুলনা-৩ আসনের এমপি মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, এরই মধ্যে আমাদের সরকার বেশ কয়েকটি বন্ধ মিল চালু করেছে। শিল্পাঞ্চলকে আমরা জীবিত করেছি। শ্রমিকদের পাওনাসহ বন্ধ মিলগুলো চালু করার বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৫৯ সালে খুলনা শিল্পনগরের খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল স্থাপন করা হয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। চালুর পর মিলটি দীর্ঘ দিন লাভজনক ছিল। আশির দশক থেকে মিলটি লোকসানের কবলে পড়ে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করায় বিদেশ থেকে প্রচুর পণ্য আসতে থাকে। তাতেই বেকায়দায় পড়ে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। এর ফলে মিলটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

 

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/304392