মাদক ব্যবসা ও সেবন নিয়ে বেশি খুন হচ্ছে পারিবারিক বিরোধও দায়ী ২০১৩ সালে ৩৯৮৮ ২০১৪ সালে ৪৫২৩ ২০১৫ সালে ৪০৩৫ ২০১৬ সালে ৮৭৯ ২০১৭ সালে ৩৫৪৯ ২০১৮ সালে ৫৪৭ জন খুন (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত)
দেশে সংঘটিত খুনের কারণ ও ধরণ উভয়ই পাল্টে গেছে। আগে রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হরহামেশাই বড় ধরনের খুনের ঘটনা ঘটত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ ধরনের খুনের ঘটনা আগের তুলনায় কমে গেছে। বেড়ে গেছে বীভত্স, বিকৃত ও রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। মাদক সেবন বিশেষ করে ইয়াবা ও এ সংক্রান্ত ব্যবসার জের ধরে সারাদেশে হচ্ছে খুনোখুনি। পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক বিরোধ, পূর্বশত্রুতা ও জমিজমা বিষয়ক দ্বন্দ্বের জের ধরে খুনের ঘটনাও পিছিয়ে নেই। মা খুন করছে সন্তানকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বস্তার ভেতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে।
সমাজবিজ্ঞানী অথবা অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এর প্রধান কারণ। নৈতিক অবক্ষয়, প্রতিহিংসা চরিতার্থ ও মাদকের ভয়ঙ্কর ছোবলসহ অনেক কারণ রয়েছে এর পেছনে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সামাজিকভাবে এই খুনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছর ২ মাসে সারা দেশে ১৭ হাজার ৫২১ জন খুন হয়েছে। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ৪১ জন। ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৯ জন। ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন খুন হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে খুন হয়েছে ৫৪৭ জন। এই দুই মাসে রাজধানীতে খুন হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই বীভত্স ও রোমহর্ষক।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আগের চেয়ে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সমাজ নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে পরিবার সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে মানুষের মধ্যে সব সময় একজন আরেকজনকে যেভাবে আগে ছাড় দেয়ার মানসিকতা বা এক সাথে চলার মানসিকতা ছিল- সেটার পরিবর্তে মানুষের এই ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা এক ধরনের সহিংসমূলক আচরণের দিকে ধাবিত করছে।
খুনের বীভত্সতা ছাড়িয়ে যাওয়ার কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ঠ। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের বেউতা এলাকায় মালয়েশিয়া প্রবাসী আল-আমিনের বাড়িতে সাভারের ভাকুর্তা এলাকার কবিরাজ মফিজুর রহমানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ৮ থেকে ১০ টুকরা করে প্রতিবেশীর মাগুর মাছের খামারসহ বিভিন্নস্থানে ফেলে রাখা হয়। প্রথমে হাত-পা, মাথাবিহীন শরীর ও পরে মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ এক নারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায়, কবিরাজি চিকিত্সা করানোর নামে শারীরিক সম্পর্ক ও প্রতারণার প্রতিশোধ নিতেই মফিজুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
গত বছরের ২ নভেম্বর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকার ময়নারটেকের একটি বাসায় বাবা জামিল শেখ ও মেয়ে নুসরাতকে খুন করে মা আরজিনা বেগমের কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক। ১ নভেম্বর কাকরাইলে পারিবারিক কলহের কারণে খুন করা হয়েছে মা শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে। গত বছরের ১৫ অক্টোবর যাত্রাবাড়ীর পশ্চিম মাতুয়াইল কাজীরগাঁও এলাকায় মাদকাসক্ত বাবা তার চার বছর বয়সী সন্তান শাহীনকে খুন করে বাথরুমে পানির ড্রামে লাশ লুকিয়ে রাখে। গত ২৭ অক্টোবর মিরপুরের দুয়ারীপাড়া ৫ নম্বর গলির টিনশেড বস্তির একটি ঘরের মেঝে খুঁড়ে কালাম নামে এক যুবকের কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শামীম নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। শামীম গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, তারা দুজনে বন্ধু। দুই বন্ধু ভালোবাসতেন এক নারীকে। ওই নারীকে পাওয়ার জন্য শামীম কালামকে খুন করে লাশ নিজের ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখে।
সর্বশেষ গত ২৩ জানুয়ারি বাড্ডার আফতাবনগর এলাকার একটি ঝিল থেকে জিসান নামে এক স্কুল ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের আগে ১৯ জানুয়ারি জিসান খিলগাঁও এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় জিসানের বাবা তোফাজ্জল হোসেনের কাছে লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করে জিসানের তিন বন্ধুকে গ্রেফতার করে। তারা ইয়াবা সেবনের টাকার জন্য জিসানকে একটি কক্ষে আটকে রাখে। মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে তারা তাকে হত্যা করে লাশ ঝিলের পানিতে ফেলে দেয়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর রেলষ্টেশনে পরিত্যক্ত লাগেজ থেকে আঁখি নামে এক কলেজ ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি তদন্ত করে পুলিশ দেখতে পায় যে, পল্লবীতে আঁখি তার মামাতো ভাই রায়হানের বাসায় থাকতেন। রায়হান বিবাহিত। ঘটনার সময় রায়হানের স্ত্রী বাসায় ছিলেন না। এই সময়ের মধ্যে রায়হান আঁঁখিকে ধর্ষণ করে হত্যার পর লাশ লাগেজে ভরে রেলষ্টেশনে রেখে আসে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া খুনোখুনির ঘটনার বেশিরভাগই তদন্ত করে একাধিক খুনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে পারিবারিক বিরোধ বা দাম্পত্য কলহ জড়িত রয়েছে। পারিবারিকভাবে সচেতনতা বাড়ালেই এসব ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।