২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ১২:১৯

মারাত্মক হুমকিতে আবাসন খাত

চরম সংকটের দিকে যাচ্ছে দেশের আবাসন খাত। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে আবাসন খাতের প্রধান উপকরণ রড সিমেন্টসহ অন্যান্য জিনিসের দাম। নিত্যপণ্যের মতো নির্মাণ সামগ্রীর দাম হু হু করে বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছে এখাতের সংশ্লিষ্টারা। তারা বলেছে আবাসন খাতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে কাজ করছে সিন্ডিকেট।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আল আমিন বলেন, নির্মাণ উপকরণের হঠাৎ করে এমন দাম বৃদ্ধিতে আবাসন শিল্পকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ করবে। আবাসন খাত যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সেই মুহূর্তে নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে নির্মাণ কাজ গতিহীন হয়ে পড়বে। ফলে যথাসময়ে ফ্ল্যান্ট হস্তান্তর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। এতে দুর্ভোগে পড়বে চুক্তিবদ্ধ ক্রেতারা। তাই এখনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সিমেন্টের দাম। নীতি নির্ধারণী মহল দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে নানা উদ্যোগের কথা বললেও খুচরা কিংবা পাইকারি অথবা উৎপাদন পর্যায়ে নানা অজুহাতে বাড়ছে সিমেন্টের দাম। ক্রেতাদের অভিযোগ উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের ইচ্ছায় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণ হওয়ার কারণেই ঠকছে ভোক্তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত ৬ মাসে বিভিন্ন কোম্পানির ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তা প্রতি দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ থেকে ১০০টাকা।
৬ মাস আগে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোম্পানির সিমেন্টের দাম প্রতি ৫০কেজি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হত ৩৬০ থেকে ৩৯০ টাকা। বর্তমান বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা দামে।
সিমেন্ট তৈরিতে কাচঁমালের উপর কোন ধরনের চার্জ বা কর আরোপ করা হয়নি। বাড়েনি কাঁচমালের দাম। তবুও উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশ-বিদেশে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধিই দাম বাড়ার মূল কারণ। এছাড়া টাকার বিপরীতে ডলার দাম বেড়ে যাওয়া, পরিবহন খরচ, জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা সিমেন্টের দাম বৃদ্ধিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আবসান খাত সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি খুচরা সিমেন্ট ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ক্রাউন সিমেন্ট ৪৬০ টাকা, ফ্রেশ সিমেন্ট ৪৬০টাকা, রুবি সিমেন্ট ৪৪০ টাকা, আকিজ সিমেন্ট ৪৪৫ টাকা, শাহ সিমেন্ট (স্পেশাল) ৪৬০ টাকা, প্রিমিয়ার ৪৪০ থেকে ৪৩০ টাকা, হোলসিম ৪৪৫ টাকা, স্ক্যান ৪৩০ টাকা, সুপার ক্রিপ ৪৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও এসব সিমেন্টের প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা কমে বিক্রি করা হয়েছে।
কারওয়ান বাজারে খুচরা সিমেন্ট বিক্রেতা ফারুক মৃধা বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি বস্তা সিমেন্টে ৬০ থেকে ৮০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা খুচরা ব্যবসায়ী। দাম বাড়ার কারণ আমরা কিভাবে বলব? প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ টাকা দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতি বস্তায়। আমরা যা দাম দিয়ে নিয়ে আসি তা থেকে ৫ থেকে ৮ টাকা বেশি দিয়ে বিক্রি করি। তিনি আরও জানান অস্বাভাবিক হারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কিছু দিন ধরে মাল ক্রয় বন্ধ রেখেছি। বাজার স্বাভাবিক হলে আবার কিনব।

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি বস্তায় (৫০কেজি) কাঁচামালের খরচ বেড়েছে ৮০ টাকা পর্যন্ত। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন হিসেবে- ক্লিংকার ৪০ ডলার থেকে বেড়ে ৬৩ ডলার, স্লাইড ১৮ ডলার থেকে বেড়ে ৩০ ডলার হয়েছে, ২৪ ডলারের জিপসাম ৩২ ডলার, ফ্লাই অ্যাশ ২১ ডলার এখন ২৯ ডলার, লাইমস্টোন ১৮ ডলার তা এখন ২৮ ডলার, ডলার মূল্য ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৪ বা ৮৫ টাকা হয়েছে।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ব্যবধানে বিভিন্ন মানের রডে টন প্রতি দাম বাড়ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। সরকারের পক্ষে থেকে নির্মাণধীন সমগ্রীতে কোন ধরনের চার্জ বা কর আরোপ করা হয়নি, বাড়েনি রড তৈরির কাচঁমালের দাম। তবুও আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামাল বিলেট ও স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে প্রতিনিয়ত রডের দাম বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)র হিসাবে এক সপ্তাহ আগে ৬০ গ্রেডের রডের টন প্রতি বাজার মূল্য ছিল ৫৯ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ৪০ গ্রেডের রডের টন প্রতি বাজার মূল্য ৫০ থেকে ৫১ হাজার টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বর্তমানে ৬০ গ্রেডের প্রতি টন রডের বাজার মূল্য প্রায় ৬৮ থেকে ৭০টি হাজার টাকা। আর একবছর আগে ৬০ গ্রেডের রডের বাজার মূল্য ছিল ৫২ থেকে ৫৩ হাজার টাকা। ৪০ গ্রেডের রডের প্রতি টনের বাজার মূল্য ছিল ৪২ থেকে ২৩ হাজার টাকা।

দাম দৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে নবাবপুরের আরাফাত এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার আব্দুল মান্নান বলেন, “গত এক সপ্তাহ ব্যবধানে রডের মূল্য ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। হঠ্যাৎ করে রডের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি আমরা। কারণ রডের দাম বাড়লে বিক্রি কম হয়।
তিনি বলেন, কাঁচামালের দাম কিছুটা বেড়েছে, তাই আমাদেরকে কিনতে হচ্ছে বেশি দাম দিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে রডের পরিবহন খরচ। আগে এক ট্রাকে যে পরিমাণ রড আনা যেত এখন তা আনা যায় না। ফলে রডের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্সস্ট্রাকশন ইন্ড্রাস্টিজের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুনীর উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজরেও কাঁচা মালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্বেও অতিরিক্ত মুনাফা লোভে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রির দাম বাড়াচ্ছে উৎপাদকরা। জানালেন,
নির্মাণ সামগ্রীর দাম এভবে ক্রমাগত বাড়তে থাকলে উন্নয়ন কাজের গতি কমে যাওয়ার আশংকার কথাও বলেন নির্মাণ শিল্পের এই ব্যবসায়ী নেতা।

এদিকে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, টাইলস, পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি নিয়ে শংকিত আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, দাম বৃদ্ধির কারণে সংকটে পড়বে আবাসন খাত। তাছাড়া গৃহঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দাম ২০-২৫ শতাংশ বাড়বে এমন শঙ্কা করছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, নির্মাণসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান দামের কারণে মারাত্মক হুমকিতে আবাসন খাত। শ্রমিকদের মজুরি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। এতে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত আবাসন খাতের উন্নয়ন। এদিকে দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেদিকে খেয়াল রেখে ব্যবসায়ীরা আবাসন খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। অর্থ বিনিয়োগ করেও ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছেন না তারা। ফলে না পারবেন ব্যবসা চালাতে, না পারবেন বন্ধ করতে।

http://www.dailysangram.com/post/323778